ঘুষ-দুর্নীতি-যৌনতা: প্রশাসনের পদস্থদের নামে ১০ বছরে ৩০০০ অভিযোগ
২৮ আগস্ট ২০১৯ ১০:১১
ঢাকা: প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারীর প্রতি অসদাচরণ, প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এসব অভিযোগ জমা হয়। গত দশ বছরে এ রকম প্রায় তিন হাজার অভিযোগ এসেছে মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা বিভাগে। এর মধ্যে কিছু অভিযোগ আমলে নিয়ে বিভাগীয় মামলার পর কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেককে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে, আবার অনেকেই পেয়ে গেছেন অব্যহতি।মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র মতে, অধিকাংশ অভিযোগই আসে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি, ঘুষ লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রলোভন দেখিয়ে নারী সহকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ নানাবিধ নৈতিক স্খলনের মতো অভিযোগ রয়েছে এ তালিকায়। আর অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক, থানা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভূমি কর্মকর্তারাও।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বলেন, এসব ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির বিধান রয়েছে। আর সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সম্প্রতি জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর ও এক নারীর আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশাসনে বিষয়টি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সর্বোচ্চ কঠোরতা দেখাচ্ছে।
এ বিষয়ে শফিউল আলম বলেন, জামালপুর জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্র জানায়, গত দশ বছরে দুই হাজার ৭৮৪ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এরকম প্রায় তিনহাজার অভিযোগ জমা পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী এদের মধ্যে ৩৬৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে এদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। এ পযর্ন্ত করা প্রায় সাড়ে চারশ মামলার মধ্যে মাত্র ৬৭ জন কর্মকর্তাকে গুরুদণ্ড অর্থাৎ চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এছাড়া ১২৬ কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড অর্থাৎ মৌখিক সতর্কতা দিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। আর ২০৩ জনকে দেওয়া হয় অব্যাহতি।
বর্তমানে ৪৪টি বিভাগীয় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত কিংবা মামলা চলাকালীন পদোন্নতি বন্ধ রাখা হয়। এমনকি অপরাধের ধরণ অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধিও বন্ধ থাকে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘুষ দাবি, নারীর প্রতি অসদাচরণ, প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে জনসাধারণের ক্ষতি করার অভিযোগই বেশি। ভিকটিম শুধু নারী কিংবা পুরুষ সহকর্মীই নন; প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণেরও অভিযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী এসব অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুত করা।
অনুসন্ধান আরও বলছে, অধিকাংশ ঘটনারই পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হয় না। যেসব ঘটনার তদন্ত হয় তাতেও শতভাগ শাস্তি নিশ্চিত করার নজির কম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, যৌন হেনস্তা বা কেলেঙ্কারির ঘটনায় ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা বিব্রত হন। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে এসব মামলা খুব বেশি দূর এগোয় না। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অনেক মামলায় সাময়িক বরখাস্ত করে কিছুদিন পর আবার তা তুলে নেওয়া হয়। অথবা অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে ডেকে লঘুদণ্ড হিসেবে মৌখিক সতর্কতা দিয়েই অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়।
এদিকে সম্প্রতি জামালপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর ও এক নারীর আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। এরই মধ্যে তাকে ওএসডি করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। আর এ ঘটনা তদন্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা) যুগ্মসচিব মুশফিকুর রহমানকে আহবায়ক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সোমবার সংবাদ সম্মেলনে জানান, কমিটি দুটি ভিডিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী শাস্তির মুখোমুখি হবে অভিযুক্ত সাবেক জেলা প্রশাসক এবং সংশ্লিষ্ট ওই নারী।
ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কয়েকমাস আগে দুর্নীতিরও অভিযোগ এসেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে, এমন প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আলাদা করে এর তদন্ত হচ্ছে না, তবে সাম্প্রতিক অভিযোগ তদন্ত করলেই তার সব অপরাধ বেরিয়ে আসবে।’
এসব অভিযোগের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন,`তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। সব অভিযোগই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। যেসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোর শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে।’
আর জনপ্রসাশন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন নিজ মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা তুলে ধরে কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জামালপুরের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে তাতে মন্ত্রণালয় বিব্রত। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৮ সালে নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর বার্তা পাঠিয়ে এক নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে হয়রানির অভিযোগ ওঠে। ওই নারী কর্মকর্তা জনপ্রশাসনে লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই জেলা প্রশাসককে ওএসডি করা হয়। আর নারী কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তবে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার অভিযোগ আনা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।