বিএনপি খুনির সৃষ্টি, খুনিদের দল: প্রধানমন্ত্রী
৩০ আগস্ট ২০১৯ ১৭:২৮
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই খুনির হাতে বিএনপি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিএনপি খুনিদের দল যদি না হবে তাহলে স্যার টমাস উইলিয়াম এমপিকে কেন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে আসতে দেয়নি?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটির পক্ষে সাফাই গাওয়ার তো কিছু নেই। বিএনপি নেতাদের এটিও জানা উচিৎ, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলকে উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে।’
শুক্রবার (৩০ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর শের-ই বাংলানগর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।
‘চরম দুঃসময়ে নেতাকর্মীরা আ.লীগকে আগলে রাখে’
১৫ আগস্টের ঘটনার পর ভাগ্যচক্রে বেঁচে যাওয়াসহ সপরিবারের নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন। পরে চোখের পানি কয়েক দফায় টিস্যু দিয়ে মুছতে দেখা যায় তাকে। শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের ঘটনায় বিদেশে অবস্থানের কারণে দুই বোনকে তৎকালীন সেনা সরকার দেশে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছিল তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কারণ এই মিলিটারি ডিটেকটররা যখন ক্ষমতা নেয় তখন তাদের মনের ভেতর একটা সুপ্ত বাসনা থাকে, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার। যদিও তারা রাজনৈতিক নেতাদেরই গালি দেয়। কারণ মোশতাক বেঈমানি করে ক্ষমতায় গিয়েছিল, আড়াই মাসও কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ঠিক যেভাবে মীরজাফর বেঈমানি করে সিরাজউদদ্দৌলাকে পরাজিত করেছিল, মীরজাফরও কিন্তও ওই দুই মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
ঠিক মোশতাকের ভাগ্যেও তাই ঘটল, সেও থাকতে পারল না। এই মোশতাকেই কিন্তু জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেছিল দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সব থেকে বিশ্বস্ত মানুষ যে মোশতাকের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। রশিদ ফারুকের সঙ্গে যে চক্রান্ত করেছিল। এ হত্যাকাণ্ড করতে উৎসাহিত করেছিল এবং সবরকম সহযোগিতা করেছিল। সেই জিয়াউর রহমানকে জেনারেল মোশতাক সেনাপ্রধান করে। আর পরবর্তী সময়ে সেই সেনাপ্রধানেই এদেশের একদিকে সেনাপ্রধান আরেকদিকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিজেকে ঘোষণা দেয় আর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে।’
‘আমরা মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেখি। টক শো বেশি একটা দেখার সুযোগ হয় না তবুও দেখি। ইদানিং বিএনপির নেতারা নিজেদের সাফাই গাইতে একটা কথা বলা শুরু করেছে। ১৯৭৫’এ তো বিএনপির প্রতিষ্ঠাই হয়নি। কাজেই তারা আবার খুন করল কীভাবে? বিএনপির যে প্রতিষ্ঠাতা, সে নিজেই যখন খুনি এবং শুধু খুনি না, খুনের সঙ্গে তো জড়িত ছিলই। আবার এই খুনিদের বিচার হবে না। তার জন্য যেমন ইমডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছিল। আর তারই বলে এই খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল।’
‘দেশের ভিতরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, যারা মোশতাকের সঙ্গে বা এ খুনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে চক্রান্তে জড়িত। তারা কিন্তু ঠিকই মোশতাকের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে জিয়ার সঙ্গেই থেকে গেছে। এখনও অনেকে বেঁচে আছে, আবার অনেকে বেশ বড় বড় কথা বলে। কিন্তু তারা যে এই চক্রান্তের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না এবং আজকে তা প্রমাণিত হয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
‘আমি যখন দেশে ফিরতে পারলাম না। ১৯৭৯ সালে প্রথম রেহানা সুইডেনে যান। কারণ সুইডেনের যিনি আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড. রাজ্জাক। তিনি মোশতাক সরকারের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেননি এবং বলেছিলেন আমি খুনিদের চাকরি করব না। তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেই পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন এবং প্রতিবাদ করেছিলেন। শুধু তাই না তিনি সেখানে একটা সভার আয়োজন করেন। তখন রেহানা ১৯৭৯ সালে সেখানে যায় এবং ১৫ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে প্রথম রেহানাই সুইডেনে প্রতিবাদ করেছিল এবং বক্তব্য দিয়েছিল। ১৯৮০ সালে আমি যখন লন্ডনে যাই এবং রেহানার পাসপোর্টের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের দূতাবাস সেই পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধি করে দেয়নি। কারণ সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমি দিল্লিতে ছিলাম। দিল্লিতে আমাদের যিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন শামসুর রহমান সাহেব, তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসামি ছিলেন। তিনি কোনো কিছু না বলে চুপচাপ আমাদের পাসপোর্টটা তিনি রিনিউ করে দিয়েছিলেন। তিনি লন্ডনের দূতাবাস রেহানার পাসপোর্ট দেয়নি। কারণ উদ্দেশ্য একটিই ছিল কোনোমতে যেন দেশে আসতে না পারে। তবে ব্রিটিশ সরকার পরে তাকে অ্যাসাইলাম দেয় এবং তাকে সেখানেই নাগরিকত্ব দিয়েছিল।
‘আমি ১৯৮০ সালে লন্ডনে গেলাম। এই ব্যাপারে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী আমাকে সহযোগিতা করেছিল এবং ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ওনাকে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছিলেন। এরপর লন্ডনে গিয়ে প্রতিবাদ সভা করি এবং সেখানে একটি ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যিনি জাতির পিতাকে সমর্থন করতে এসেছিলেন, স্যার টমাস উইলিয়ামস (কুইস কাউন্সিলের তিনি সদস্য)। তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি ছিলেন। তিনি এবং শন ম্যাকব্রাইড আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নোবেল লরিয়েট, তাকেসহ ব্রিটিশ অন্যান্য দলের এমপিদের নিয়ে আমরা একটা ইনকোয়ারি কমিটি করি এবং এই ইনকোয়ারি কমিটিতে প্রবাসী বাঙালিরা তারা সেখানে ডোনেশন দেয় এবং ইনকোয়ারি কমিটির পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসবেন, এই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবার জন্য এবং স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে আমরা ঠিক করি তিনি আসবেন এবং ওনাকে একটি সলিসিটারও নিয়োগ দেওয়া হয় যার কাছে ফান্ড থাকত এবং সমস্ত কাজগুলো হবে।
‘তিনি যখন ভিসা চাইলেন, জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি। জিয়া কিন্তু স্যার টমাস উইলিয়াম এমপিকে ভিসা দেওয়া হয়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তিনি যখন এসেছিলেন, তখন কিন্তু পাকিস্তানি সরকারও ভিসা দিয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্টের পরে যখন ১৯৮০ সালে স্যার টমাস উইলিয়ামস আসতে চাইলেন, জিয়াউর রহমান তাকে ভিসা দিলেন না।’
শেখ হাসিনা বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রশ্ন এখানে, বিএনপি নেতাদের এটা আমি বলতে চাই এবং জিজ্ঞাসা করি, জিয়া যদি খুনি না হবেন আর তার হাতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এই বিএনপি, এরা যদি খুনিদের দল না হবে আর খুনির দল না হয়, তাহলে স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে কেন বাংলাদেশে তদন্ত করতে আসতে দেয় নাই? তার দুর্বলতাটা কি ছিল? সে কিন্তু ভিসা দেয়নি। অর্থ্যাৎ এই ঘটনার কোন তদন্ত হোক, হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক, সেটা তো আইন করে আগেই বিচার বন্ধ, খুনিদের পুরস্কৃত করা এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর সাধারণত মিলিটারি ডিটেকটর যখন ক্ষমতায় আসে আগে রাজনীতিবিদদের গালি দেয়। আর এরপরে নিজেরাই উর্দি খুলে তারপরে রাজনীতিবিদ সাজতে চায়।’
‘প্রথমে হ্যাঁ, না ভোট তারপরে রাষ্ট্রপতি ভোট অনেক নাটক করে এরপরে সে রাজনৈতিক দল করল এবং সেটাও কয়েক দফা দলের নাম পরিবর্তন করে করে এই বিএনপির সৃষ্টি। আর সেই দলে যোগ দিল কে? আওয়ামী লীগের যে সকল নেতাকর্মী বেঈমান-মুনাফেক তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তারা ছাড়া সব নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং কারাগারে ছিল। আবার ৩ নভেম্বর কারাগারে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো। ১৯৭৫ থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত আমাদের সকল নেতাকর্মীরা কিন্তু কারাগারে বন্দি ছিল। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে।
বহু নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে গেছে। দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে। তার পরিবার লাশটাও পায়নি। আজকে তারা গুম-খুনের কথা বলে। এই গুম খুনের কালচার তো শুরু করেছিল জিয়াউর রহমান এই দেশে। আমাদের নারায়ণগঞ্জের ছাত্রনেতা মাহফুজ বাবু, তাকে যে তুলে নিয়ে গেল তার পরিবার তো আর তার লাশ পায়নি। শুধু আমাদের রাজনৈতিক দলের উপর এই জুলুম অত্যাচার তা নয়, সেনাবাহিনীতে যারা মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছিল। যারা একদিন জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করেছিল সেরকম বহু অফিসারকে নির্মমভাবে একের পর এক হত্যা করেছে।
‘‘শোনা যায়, জিয়াউর রহমান টেবিলে বসে খেতে খেতেই, সে কাটা চামচ দিয়েই খেত আর এই ধরনের মৃত্যুদণ্ডের ফাইলে সই করত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যারা ছিল, তারা বলতে পারবে, এমন এমন রাত আটজন দশজন করে জোড়ায় জোড়ায় ফাঁসি দিয়েছে এবং তাদের চিৎকার তাদের কান্নায় ওই কারাগারের আকাশ ভারি হয়েছে’ বলেও দাবি করেন তিনি।
‘চরিত্রটাই তো এই ধরনের খুনের। যেটা আপনারা দেখতে পারেন ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায়। কিভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হলো। আইভী রহমানসহ আমাদের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত। তাদের লাশও তো দিতে চায়নি। ২০০১ সালে এসে ঠিক ৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ড এবং গণহত্যা চালিয়েছে, বিএনপি কিন্তু সেই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করল। জঙ্গিবাদ সৃষ্টি এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মদদ দেওয়া, চোরাকারবারি, মানি লন্ডারিং এমন কোনো অপকর্ম নেই, সমাজটাকে তারা ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল।’
এই ধারাবাহিকতায় ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর, আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। এই দেশের মানুষ কি পেয়েছিল? মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তো কেউ কাজ করেনি। তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। এসব কাজে তাদের মনোযোগেই ছিল না।
আলোচনা সভায় সভায় মহানগর নেতারা ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাকান্ডে দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনীদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার দাবি জানানোর পাশাপাশি ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার মাস্টারমাইন্ডদের সাজা কার্যকর করার দাবি জানান।
ঢাকা মহানগর উত্তররে সভাপতি এ কে এম রহমতউল্লাহর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা ঢাকা মহানগর নতোদরে মধ্যে বক্তব্য রাখেন দক্ষিণের সহ-সভাপতি আবু আহম্মেদ মান্নাফী, উত্তরের সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, জাহানারা বেগম, সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি ও কামাল চৌধুরী।
সভা পরিচালনা করেন ঢাকা মহানগর উত্তরের সহপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আকতার হোসেন এবং আজিজুল হক রানা। সভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে মঞ্চে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/এনআর/একে
জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিএনপি শেখ হাসিনা