Saturday 14 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা ইস্যু: সমাধানের পথ কোথায়?


৩০ আগস্ট ২০১৯ ১৭:৪২ | আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০১৯ ১৩:৩৬
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোনো দেশের আশ্রয়ে থেকে অন্য দেশের নাগরিকদের আশ্রয় নেওয়া দেশেই সমাবেশ করার ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন। অথচ ঘটনাটা ঘটেই গেছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় নেওয়ার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সমাবেশ করলেন, স্লোগান দিলেন, বিতরণ হলো পোস্টার, লিফলেট। এ নিয়ে নানা মহলে চলছে বিশ্লেষণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন টক শো, কলাম, মন্তব্যে রীতিমত বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের জমায়েত বলা হলেও সংখ্যা নিয়ে রয়েছে ভিন্নতা। বাংলাদেশে আসার দুই বছর পূর্ণ হওয়ার দিনটিতে রোহিঙ্গারা যে সমাবেশ করেছে, সেই সমাবেশে ৩০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন— এ তথ্য দিচ্ছে মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপি। তবে বিবিসি জানিয়েছে ২০ হাজার রোহিঙ্গার জমায়েতের কথা, এএফপি ২ লাখ। পুলিশের বরাতে ওই সমাবেশে একলাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতির তথ্য পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

পুরো দেশে যখন সমাবেশ নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হলো, ঠিক তখনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানাল, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। প্রত্যাবাসন নিয়ে গণমাধ্যমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বিদেশি সহায়তা কমে গেলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা আর আরামে থাকতে পারবে না। দু’টি মন্তব্যই বেশ করার মতো। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী ওই সমাবেশের উপস্থিতি ২০ হাজার ধরলেও এত মানুষের সমবেত হওয়ার ঘটনা সরকারের অলক্ষ্যে হওয়ার কথা নয়। আবার রোহিঙ্গাদের আরামেই যদি থাকতে দেওয়া না হয়, তাহলে তড়িঘড়ি করে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে থাকার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে কেন?

সরকারের ভাবনা, আন্তর্জাতিক মহলের রাজনীতি, আর রোহিঙ্গাদের আচরণ— সবকিছুই যেন বুমেরাং হয়ে গেছে। আশ্রয় দিয়ে ‘প্রশংসা’ ছাড়া সংকট থেকে উত্তরণের দিকনির্দেশনার দেখা মিলছে না বাংলাদেশের।

রোহিঙ্গাদের এই সমাবেশের ঘটনাকে অবশ্য নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন না অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান জুলহাস আলম। তিনি বলেন, তাদের সুসংগঠিত রাখাটা দেশের নিরাপত্তার জন্য জরুরি। যদিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। এ জন্য বাংলাদেশকে জাতিসংঘের পাশাপাশি আলাদা রাষ্ট্রগুলোকে বোঝানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। জাতিসংঘের নির্ভরতা তো থাকবেই কিন্তু বাংলাদেশকে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার ব্যাপারটিতে আরও জোরদার করতে হবে এ সংকট সমাধানে। বিশেষ করে ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়া, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে পারলেই কেবল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে।

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, রোহিঙ্গারা এসে আশ্রয় নেওয়ায় বাংলাদেশকে ন্যূনতম কী কী খোয়াতে হয়েছে।

বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে চার হাজার একর পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি গড়া হয়েছে। এসব পাহাড়ের একেকটির বয়স দেড় থেকে দুই কোটি বছর। আবার পাহাড় কেটে ঝুপড়িঘরগুলো তৈরি করেছে রোহিঙ্গারা নিজেরাই। কক্সবাজার জেলা বন অফিসের হিসাবে, উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে৷ এছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে। স্থানীয় পরিবেশবাদীদের হিসাবে, পাহাড়ের আশেপাশের জায়গা ধরলে রোহিঙ্গাদের বস্তির জায়গার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর।

গত ১০ মে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফ্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ৫৭ দশমিক ৮৬ শতাংশই এখন কক্সবাজারের শ্রমবাজারে যুক্ত, সেখানে স্থানীয়দের ক্ষেত্রে এই হার ৫১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে আসা খবর থেকে জানা যাচ্ছে, গত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন রোহিঙ্গা। এছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও ৩২ রোহিঙ্গার মৃত্যুর কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু গত দু’বছরেই ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। এর মধ্যে মাদক মামলা ২০৮টি, হত্যা মামলা ৪৩টি ও নারীঘটিত মামলা ৩১টি। এসব মামলায় আসামি এক হাজার ৮৮ রোহিঙ্গা।

সম্প্রতি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের পেছনে গত দুই বছরে বাংলাদেশ সরকারের খরচ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। রোহিঙ্গাদের পেছনে প্রতি মাসে সরকারের খরচের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, রোহিঙ্গাদের দেখভাল করতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ দিতে হয়েছে। রোহিঙ্গা না থাকলে রাষ্ট্রের এই খরচ দেশের মানুষের সুবিধায় অন্য কাজে লাগানো যেত।

নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে সরকার রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে। অথচ চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংগি লি ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তাড়াহুড়ো করে একটি দ্বীপে রোহিঙ্গাদের পাঠানো হলে মিয়ানমারের কাছে ভুল বার্তা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমার এমন বার্তা পেতে পারে যে বাংলাদেশেই রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে, তাদের ফেরত না নিলেও চলবে। মিয়ানমার একটি জঘন্যতম অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে বলে ভাবতে পারে।

দুইটি সাধারণ প্রশ্ন সবার মাথায় ঘুরছে— গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্তে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বাস প্রস্তুত ছিল। প্রস্তুত ছিল নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু আসলেই কি শুরু হওয়ার কথা ছিল? রোহিঙ্গারা যে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবে না, তা কি কারও অজানা ছিল? নাকি সবটাই কোনো পক্ষের সাজানো নাটক ছিল!

এখন রোহিঙ্গারা কোথায় যাবেন? যুক্তি আসতে পারে, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশের নয়। কিন্তু এমন যুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ যে জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হবে না। ফলে রোহিঙ্গারা কোথায় ফিরবেন, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ নিজেই কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। তবে, এটাও সত্য— আন্তর্জাতিক নানা চুক্তিতেই বাংলাদেশ কিন্তু সই করে রেখেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলছে নানা বিশ্লেষণ। এর মধ্যে জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত গবেষক নাদিম মাহমুদের ওয়াল থেকে কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো—

‘ছবিটা (রোহিঙ্গাদের সমাবেশের ছবি) একটি ভয়ানক ইঙ্গিত দিলো। ঘর ছাড়ার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে রোহিঙ্গা শিবিরে যে সমাবেশটি আজ হলো, সেই সমাবেশটি যদি দুই বছর আগে তারা রাখাইনে দেখাতে পারত তাহলে আজকে তাদের এই পরিণতির শিকার হতে হতো না। আজ যে রোহিঙ্গারা স্লোগান দিলো, সেই স্লোগান যদি তাদের ভিটেমাটি রক্ষার জন্য সুচির কার্যালয়ের সামনে দিত, তাহলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পরিণতি ভয়াভয় হতে পারত।

আজ যে সম্মেলন হলো, কাল সেই সম্মেলন কক্সবাজার, পরের দিন চট্টগ্রাম হলে সরকার তা সামলাতে পারবে তো? বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দিনটির প্রথম বর্ষপূর্তিতে কোনো দিবস পালন করতে না পারলেও ঘটাও করে দ্বিতীয় বছর রোহিঙ্গারা সমাবেশ করলো, সেই সমাবেশে সক্ষমতার দাবিদার কারা? যে মানিববতা বাংলাদেশ বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে, সেটি কয়েকমাস পর যেন অমানবিক হতে না হয়। গুজবের এই ব-দ্বীপে রোহিঙ্গায় থাকবে ভোট, রোহিঙ্গায় থাকবে ডাঙ্গা, রোহিঙ্গায় থাকবে সরকার, আবার রোহিঙ্গাই হবে আগামী বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত।’

আগস্ট মাসটা আক্ষরিক অর্থেই ভয়াল হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, একযোগে ৬৪ জেলায় হামলা। এই আগস্ট মাসেই জাতিসংঘের ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত বাস্তুহারা মানুষের স্রোত আসে বাংলাদেশে। অনেকেই হয়তো বলবেন, অন্য ঘটনাগুলোর সঙ্গে রোহিঙ্গা সম্পৃক্ততা কেন? এর জবাব হচ্ছে, —রোহিঙ্গারা নিজেদের যে শক্তি দেখালেন বাংলাদেশে, এই ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য কী বয়ে আনছে তা কে জানে?

বেশ কয়েকমাস আগের একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করি। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ উঠতেই বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন, ‘আমি কোনো রাস্তাই খুঁজে পাচ্ছি না’।

রোহিঙ্গা: সমাধানের পথ কোথায়?