সেপ্টেম্বর মানেই ডেঙ্গু আতঙ্ক!
৩১ আগস্ট ২০১৯ ০০:২৫
ঢাকা: এ বছর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী আরও ১৮ বছরে যেখানে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ১৪৮ জন, সেখানে এ বছর ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সেই সংখ্যা ৬৯ হাজার ৪৩৫ জন! গত কয়েকদিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কিছুটা হলেও কমতে থাকায় অবশ্য স্বস্তি খুঁজছিলেন কেউ কেউ। তবে পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। সেপ্টেম্বর মাস মানেই যেন ডেঙ্গুর জন্য আতঙ্ক!
গত কয়েকবছর ধরেই এই মাসেই যে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। পরিসংখ্যানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে গত সপ্তাহখানেক ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমলেও সামনে ‘ভয়ংকর’ সেপ্টেম্বর পড়েই আছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছরে সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ১৬২ জন। ওই বছরে জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলেও ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসেই।
২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬০ জনে। ওই বছর মে মাস থেকেই দেখা দেয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। জুন, জুলাই, আগস্ট পেরিয়ে সে বছরও সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসেই। ২০১৭ সালে জানুয়ারি মাস থেকেই পাওয়া যায় ডেঙ্গুর রোগী। তবে জুন মাস থেকে প্রকোপ বাড়তে থাকে। আগের বছরের মতোই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন সেপ্টেম্বর মাসে। ওই মাসে ৩৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওই বছরে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল এক হাজার ৬৪১ জন।
২০১৮ সালে ছাড়িয়ে যায় আগের সব বছরের রেকর্ড। এ বছরে মোট ১০ হাজার ১৪৮ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ওই বছরের জুলাই মাসে ৯৪৬ জন ও আগস্ট মাসে এক হাজার ৭৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আর শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৮৭ জন।
এ বছর এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে জুন মাস থেকে। তবে জুলাই ও আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার আগের সব রেকর্ড ছাড়ায়। জুলাই মাসের শেষ সাত দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হন ছয় হাজার ৩৫২ জন ডেঙ্গু রোগী। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এই সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৭৫৯, দ্বিতীয় সপ্তাহে ১৪ হাজার ১১ জন, তৃতীয় সপ্তাহে ১১ হাজার ৬২৭। সর্বশেষ গত ২৩ থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত সাত দিনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৩৯৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই হিসাব অনুযায়ী আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। তবে তাতে স্বস্তি পাচ্ছেন না চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা। কারণ আগের বছরগুলোর তথ্য থেকে তারা আশঙ্কা করছেন, আসছে সেপ্টেম্বরেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অব্যাহত থাকতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছরই আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি। এ বছরের আগস্ট মাস তো সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আর যেভাবে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তাতে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
তবে সেই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত নাও হতে পারে— এমন সম্ভাবনার কথাও শোনালেন কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এ বছরে রোগীর পরিমাণ ১৯ বছরের সব হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া যেকোনো রোগেরই একটি পিক আওয়ার থাকে। আমার ধারণা, ঈদুল আজহার আশপাশের সময়টিতে ডেঙ্গুর সেই পিক আওয়ার আমরা পেরিয়ে এসেছি। তাছাড়া গণমাধ্যমে লেখালেখির মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের ওপর যথেষ্ট চাপ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তারা বিভিন্ন ধরনের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষও যথেষ্ট সচেতন হয়েছে, প্রত্যেকেই যে যার জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে এ বছরের সেপ্টেম্বর মাস হয়তো তেমন ভয়ংকর হয়ে নাও উঠতে পারে।
গবেষকরা জানান, ডেঙ্গুর সঙ্গে বৃষ্টির ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। বৃষ্টির পর রাস্তায়, বাড়ির ছাদে বা যেকোনো জায়গায় যে স্বচ্ছ পানি জমে, সেটিই ডেঙ্গুর লার্ভা বেড়ে ওঠার আদর্শ পরিবেশ। ফলে সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টি কতটুকু হবে, সেটিও হয়তো ডেঙ্গুর প্রকোপের অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু বিষয়ক কর্মসূচির ব্যবস্থাপক ডা. এম এম আখতারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর, অক্টোবর বা নভেম্বর কোনো বিষয় না, মূল বিষয় হলো আবহাওয়া। বাতাসে ৫৫ শতাংশের বেশি হিউমিডিটি থাকলে সেটাকে এডিস মশার প্রজজনের সম্ভাব্য উপযোগী পরিবেশ মনে করা যেতে পারে। এই মুহূর্তে আমাদের হিউমিডিটি হলো ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশের মতো। সেক্ষেত্রে এখন এডিস মশার প্রজননের অনুকূল পরিবেশ নেই। তবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বা থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়াটা এডিস মশার প্রজননে সহায়ক। এগুলোই মূলত নির্ধারণ করবে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন থাকবে।
ডা. আখতারুজ্জামান আরও বলেন, যেহেতু এবার ডেঙ্গু একটু তাড়াতাড়িই শুরু হয়েছে, তাই আগস্ট নাগাদ এটি সর্বোচ্চ মাত্রায় হিট করেছে। এখন একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। সিটি করপোরেশনের অভিযান ও নাগরিক সচেতনতা অব্যাহত থাকলে আশা করছি ডেঙ্গুর প্রকোপ আর বাড়বে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ডিন ও মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে শীতের আগ পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকেই যায়। তাই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঝুঁকিটা থাকছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট আবহাওয়ার তারতম্যের কারণেই এই শঙ্কা থাকে। ভারী বর্ষণ না হয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। আর সেখানেই ডেঙ্গু মশা ডিম পাড়ে বেশি। এই পানি পরিচ্ছন্ন রাখাটাই মূল কাজ।’
কেমন থাকতে পারে এ বছরের সেপ্টেম্বরের আবহাওয়া— জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু দেখেছি, তাতে সেপ্টেম্বরে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুব কম। বঙ্গোপসাগরে কোনো নিম্নচাপ তৈরি না হলে বা মৌসুমী কোনো বড় ধরনের নিম্নচাপ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে না গেলে হয়তো ভারী বর্ষণ হবে না। তবে এগুলোর কথা এত আগে থেকে বলা কষ্টসাধ্য।’
আবহাওয়ার কারণে এডিস মশা প্রজজনের উপযোগী পরিবেশ পেলেও ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মশা নিধন কর্মসূচিতে জোর দিলেন ডা. এম এম আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, আবহাওয়ার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে মশার ব্রিডিং সোর্স নিয়ন্ত্রণে রাখা ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখার কাজটি আমাদেরই করতে হবে। ঘর যেন মশার ব্রিডিং সোর্সে পরিণত না হয়, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
গত সপ্তাহখানেক হলো ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার কমলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এসেছে— এমন দাবি করার সময় হয়নি বলে জানালেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কমতির দিকে। আমরা আশা করছি এই হার অব্যাহত থাকবে। তবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে— এটি বলার সময় এখনো আসেনি। আমরা যদি ডেঙ্গু মোকাবিলায় নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারি এবং সংশ্লিষ্ট সবার নেওয়া উদ্যোগগুলোও চলমান রাখতে পারি, তাহলেই কেবল সেপ্টেম্বর মাসের আতঙ্ক থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরাও সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গু কমে যাচ্ছে বলা মানে কিন্তু এই না যে ডেঙ্গু নির্মূল হয়ে গেছে। আমরা যেটা বলতে পারি, তা হলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে। এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে।
আবহাওয়া অধিদফতর ডা. মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা ডা. সানিয়া তাহমিনা ডেঙ্গু সেপ্টেম্বর