Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: এনজিওদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন


৩১ আগস্ট ২০১৯ ০৮:৩৪

কক্সবাজার: বাংলাদেশে অবস্থানের দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এবং মিয়ানমারের সম্মতিতে দু’বার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা হলেও সেসব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের তেমন কেউই রাখাইনে নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। রাখাইনে তাদের থাকার উপযুক্ত পরিবেশ বা নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা আছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) প্রত্যাবাসন বিষয়ে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করছে।

বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গা অবস্থানের এই দুই বছরে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দুইবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়। সবশেষ গত ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। দুই বারই রোহিঙ্গারা বলেছে, মিয়ানমার তাদের দাবি না মানলে তারা ফিরবে না। তাদের ৫ দাবির মধ্যে রয়েছে— নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বিচার, ঘরবাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া এবং সহজ চলাচল নিশ্চিত করা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে আসার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে ২৫ আগস্ট এই পাঁচ দফা দাবিতে মহাসমাবেশও করেছে রোহিঙ্গারা। ওই দিন সেই মহাসমাবেশ থেকে স্লোগান তোলা হয়, ‘উই আর রোহিঙ্গা, উই আর নট বাঙালি।’ অভিযোগ রয়েছে, কয়েকটি এনজিও ওই মহাসমাবেশ আয়োজনে সহায়তা করেছে। ব্যানার-ফেস্টুনের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে ওই এনজিওগুলো।

২২ আগস্ট দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীও বলেছেন, বেশকিছু এনজিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে কাজ করছে। খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়ার জন্য শিবিরগুলোতে অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রচারণা চালাচ্ছে। চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কক্সবাজারের সরকারি দফতর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত সাড়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থান করছে। তাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি নিরাপত্তা, খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদনসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি এইসব সুযোগ-সুবিধা ও সেবা দিতে কাজ করছে দেশি-বিদেশি প্রায় ১২৫টি এনজিও। এতে মূল ভূমিকায় রয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী ও ত্রাণ বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, অভিবাসন সংস্থা আইওএম, খাদ্য কর্মসূচি ডাব্লিউএফপি। এছাড়াও দেশি-বিদেশি অন্যান্য এনজিও তো রয়েছেই।

স্থানীয়দের কারও কারও অভিযোগ, প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করার পেছনে সবচেয়ে ভূমিকা রাখছে আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো। এদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যানবাহন চলাচলের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এসব আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে সেসব বিধিনিষেধ মানা হয় না। ক্যাম্পের মধ্যে এনজিওগুলোর কার্যক্রম মনিটরিংও কঠোর নয় বলে জানান তারা।

কেবল প্রত্যাবাসন নয়, উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা নিয়েও ভুল ধারণা রয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। তাদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার নয়, সহায়তা সংস্থাগুলোই তাদের থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশ আমাদের খাওয়াচ্ছে না। আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে ডব্লিউএফপি, ইউএনএইচসিআর, আইওএম আর এনজিওগুলো। তাই তারা যা বলে তাই শুনব। অন্যদের কথা শোনার দরকার নেই।

এনজিওগুলো তাদের মিয়ানমারে ফেরত যেতে বাধা দিচ্ছে কি না— এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে রাজি হননি কোনো রোহিঙ্গাই।

এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজারে ‘মুক্তি’ নামে একটি এনজিওর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ধারালো অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ ওঠে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন এক কামারের দোকান থেকে পুলিশ বেশকিছু ধারালো অস্ত্রও জব্দ করে। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।

মুক্তির পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগণের কৃষি কাজের জন্য নিড়ানি তৈরির কাজ করছিল তারা। মুক্তির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র দে বলেন, ‘মুক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ঠিক না। আমরা রোহিঙ্গাদের কোন ধারালো অস্ত্র সরবরাহ করছি না। বরং রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগণের কৃষি কাজের জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে নিড়ানি তৈরি করা হচ্ছিল। বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হলে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো জব্দ করেছে। পরে প্রশাসনও বুঝতে পেরেছে, অভিযোগটি সঠিক নয়।’

মুক্তির এই আত্মপক্ষ সমর্থন সত্ত্বেও এর ছয়টি প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ এনজিও ব্যুরো। জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই ছয় প্রকল্প বন্ধ থাকবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর সরাসারি অভিযোগ রয়েছে ইন্টারসেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) কর্মকর্তা সৈকত বিশ্বাসের নামেও। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন টাস্কফোর্সের জরুরি সভায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি সূত্র। স্থানীয় সুশীল সমাজের সদস্যরাও বলছেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক ধারণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন এই এনজিও কর্মকর্তা। এ বিষয়ে তার মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, আমরা যতটুকু জানি, কিছু স্থানীয় ও বিদেশি এনজিও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ভুল বুঝাচ্ছে। তারা রোহিঙ্গাদের বলছে, ‘তোমরা মিয়ানমারে ফিরে গেলে আবার নির্যাতন করা হবে।’ এছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে তাদের আতঙ্কিত করা হচ্ছে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক দীপক শর্মা দীপু বলেন, দেশি-বিদেশি কিছু এনজিও’র দায়িত্বই রয়েছে প্রত্যাবাসনেরে জন্য রোহিঙ্গাদের বোঝানো ও উৎসাহিত করা। কোনো কোনো এনজিও এই দায়িত্বকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা না বলে বরং উল্টোটা বোঝাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর পূর্তিতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সমাবেশই এর প্রমাণ। ওই সমাবেশে ব্যানার, প্লাকার্ড আর ফেস্টুন দিয়ে সহযোগিতা করেছে কিছু এনজিও।

কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, ‘সব বধরনের প্রস্তুতি থাকার পরও রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাচ্ছে না কেন? বাংলাদেশ তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। তাই বলে তাদের দাবির দায়ভার কেন এ দেশ নেবে? সেটা মিয়ানমারের ব্যাপার। তারাই এর সমাধান করবে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে এসব দাবির কথা বলে নিজেদের লাখ টাকার চাকরি বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হতে দিচ্ছে না। এটা একধরনের দেশবিরোধী কাজ। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

এ বিষয়ে একাধিক এনজিও’র বিভিন্ন স্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা কেউ সরাসরি উদ্ধৃত হতে রাজি হননি। তবে তাদের সবার বক্তব্য প্রায় একই, প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কি না, সেটা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে তাদের।

একজন এনজিও কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, এনজিওগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় না, এমন অভিযোগ কোনোভাবেই সঠিক নয়। বাংলাদেশ সরকারও যেমন চায় প্রত্যাবাসন হোক, এনজিওগুলোও চায় প্রত্যাবাসন হোক। তবে রাখাইনে রোহিঙ্গারা নিরাপদ কি না, সেটা আগে নিশ্চিত হতে হবে। মিয়ানমার এমন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পেরেছে, সেটা রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে না।

অ্যাকশন এইডের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা সুমন পারভেজ সারাবাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ করে থাকে। এর বাইরে কিছু করার বা রোহিঙ্গাদের কিছু বলার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তো নয়ই।

সুমন আরও বলেন, তবে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি এখনো রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয়। এই দিকটি বিবেচনা করে ইউএনএইচসিআর বা আন্তর্জাতিক কমিউনিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যেন রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না হয়। এর অর্থ এই নয় যে এসব সংস্থা প্রত্যাবাসন চায় না। কিন্তু এমন বক্তব্যকেই হয়তো ‘এনজিও বা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে’— এমন হিসেবে প্রচার করে থাকতে পারে কেউ কেউ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ভুল বুঝাচ্ছে— এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। তবে এখনো এ বিষয়ে কেউ সরাসরি কোনো অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে কিংবা এমন ঘটনার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ট্রেনে কাটা পড়ে বৃদ্ধার মৃত্যু
২১ অক্টোবর ২০২৪ ২১:৫২

ফটোসাংবাদিক শোয়েব মিথুন আর নেই
২১ অক্টোবর ২০২৪ ২১:০৭

সম্পর্কিত খবর