সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কমছে ডেঙ্গু রোগী
১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৯:১৬
ঢাকা: ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের বারান্দায়ও রোগীদের তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল চিকিৎসক ও নার্সদের। তবে ডেঙ্গু রোগীর জন্য আলাদা দুটি ওয়ার্ড নির্মাণ ও নতুন ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কমে আসায় হাসপাতালের চিত্র কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন শিশু ওয়ার্ড বাদে হাসপাতালের বারান্দায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী নেই বললেই চলে।
সামগ্রিকভাবে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্তদের সেবা দেওয়ার মান বাড়লেও শিশু ওয়ার্ডে এখনও বেশ ভোগান্তি রয়েছে। আক্রান্ত রোগীদের স্বজনেরা এখনও রয়েছে শঙ্কা আর উৎকণ্ঠায়। হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই রোগীদের সঙ্গে স্বজনদের বাড়তি ভিড় রয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
মিরপুর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে হৃদয়। গত ২৪ আগস্ট জ্বর হওয়ার পর ২৭ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
সদ্য এইচএসসি পাস করা এই শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে এখানে আসি। সরাসরি ভর্তিও করায়নি। ডাক্তারের পরামর্শে ছিলাম। জ্বর কমে গেলে পেট ফুলে যাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হই।’
হৃদয়ের ভাই মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে চিকিৎসার মান মোটামুটি। শুক্রবার হওয়ায় বাইরে থেকে কিছু রিপোর্ট করিয়ে আনতে হয়েছে। দেরি হবে তাই বাইরে থেকে করিয়েছি। তবে এই হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় সব ফ্রি।’
হাসপাতালটিতে ভর্তি শিশু রাকানকে তরল জাতীয় খাবার খাওয়াচ্ছিলেন মা লিমা। দ্বিতীয় শ্রেণীর এই শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে তিনদিন আগে।
উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা রোগীর মা লিমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে ৬ দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। কোনো কিছু খেতে পারে না। ওকে নিয়ে খুব শঙ্কায় আছি।’
লিমা বলেন, ‘শিশু ওয়ার্ডের বারান্দায় আছি। ভেতরে সিট পাইনি। আর ভেতরেও গরম বেশি।’ সেবার মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘ডাক্তাররা একবার এসে দেখে যায়। আয়া আর নার্সরা আসে না। তাদের ব্যবহারও ভালো না। ওনাদের মধ্যে শৃঙ্খলাও নেই। আয়ারা বারান্দার ফ্যান বন্ধ করে রাখে। বলে ঝাড়ু– দিচ্ছি। কিন্তু ঝাড়ু– দেওয়া শেষ হলেও ফ্যান চালু করে না। ফ্যানের বাতাস কম লাগায় এখানে মশারি টানানো ছাড়া ঘুমাতে হয়।’
দুইবছরের শিশু জান্নাত ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা শিশুটির মা গোলাপী আক্তার বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। চিকিৎসা করালেও জ্বর কমেনি। পরে এখানে এনেছি। পরীক্ষায় এখানেও ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েটিকে নিয়ে আমরা খুব টেনশনে আছি। সিট পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে শিশু ওয়ার্ডের বারান্দাতেই আছি। মশার হাত থেকে বাঁচতে আমাদের কোনো মশারিও দেওয়া হয়নি।’
জেনেভা ক্যাম্প থেকে শিশু মিষ্টিকে এনে একই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন মা সালমা। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে জ্বর আসার পর বৃহস্পতিবার এখানে এনে ভর্তি করাই। রক্ত পরীক্ষায় ওর ডেঙ্গু এসেছে। এখন প্লেটলেট কমে আসছে। চিকিৎসরা শুধু সময়মতো এসে ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে।’
ডেঙ্গু রোগীদের জন্য খোলা নতুন মহিলা ওয়ার্ডে দেখা গেছে তা একেবারেই পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। দেশের সরকারি কোনো হাসপাতালের চিরচেনা চিত্র এটি নয়। প্রতিটি বেডের দূরত্বও বেশ। সবগুলো সিটের ওপরেই ঝুলছে নতুন মশারি। ওয়ার্ডের ভেতরে চলাচলের পথও বেশ প্রশস্ত। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন মহিলা এই ওয়ার্ডে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ইশিতার পরিবারের সঙ্গে।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ইশিতা ফার্মগেটের একটি কোচিং সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং করেছিলেন।
ইশিতার বাবা আবু ইসহাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়ের জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভর্তি করিয়েছি। ওর অসুস্থ হওয়ার খবর শুনে আমরা টাঙ্গাইল থেকে ছুটে এসেছি। মেয়েকে নিয়ে উৎকণ্ঠা আর শঙ্কায় আছি।’
কল্যাণপুরের বাসিন্দা সানজিদা গত এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে আক্রান্ত। সম্প্রতি তাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সানজিদার ভাই নাদিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিট পাচ্ছিলাম না। ইমার্জেন্সি না হলে এখানে ভর্তি করায় না। তৃতীয় দিন হাসপাতালে আসার পর ভর্তি করা হয়েছে। এই ওয়ার্ডের চিত্র ভালো থাকলেও অন্য স্থানে খারাপ।’
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ২২৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন।
হাসপাতালের পরিচালক ড. উত্তম কুমার বড়য়া সারাবাংলাকে বলেন, আগের চেয়ে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। এখন ভর্তির চেয়ে ছুটি বেশি হচ্ছে। এনএসওয়ান পজেটিভ হওয়ার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। আগে ২০ থেকে ২৬ শতাংশের পজেটিভ আসতো, এখন তা আসছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। গতকালের ডেঙ্গু পরীক্ষায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পজেটিভ এসেছে। আইসিইউতেও কোনো ডেঙ্গু রোগী ভর্তি নেই।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগে বারান্দাতেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সেটা এখন আর নেই। দুটি নতুন ওয়ার্ড করায় সেখানে ১৫০ থেকে ২০০ রোগী ভর্তি করার সুযোগ হওয়ায় পুরো হাসপাতালের চিত্র পাল্টে গেছে। আর এমনতিও ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা রাখা উচিৎ। আমরা সেটা করার চেষ্টা করছি।
শিশু ওয়ার্ডের ভোগান্তি বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. উত্তম কুমার বলেন, ‘শিশু ওয়ার্ডের রোগীও অনেক কমেছে। আগে ১৫০ রোগী ভর্তি থাকতো, এখন তা ১০০ তে নেমে এসেছে। কিন্তু শিশু ওয়ার্ডে অন্য রোগী থাকায় এখনও চিত্র পুরোটা পাল্টেনি। ভোগান্তি নিরসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’