আসামেও কি ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি’ সৃষ্টি হবে?
১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:১৪
বিশ্বজুড়ে প্রকট হচ্ছে বাস্তুচ্যুত, শরণার্থী ও উদ্বাস্তু সমস্যা। এরইমধ্যে ভারতের আসামে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ নতুন ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। হালনাগাদ তথ্যে জায়গা হয়নি রাজ্যটির ১৯ লাখ অধিবাসীর। তারা এখন আইনিপ্রক্রিয়ায় নিজেদের ভারতীয় হিসেবে প্রমাণ করতে না পারলে বিবেচিত হবেন ‘রাষ্ট্রহীন’ হিসেবে।
এত বিপুল সংখ্যা মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে উৎকণ্ঠা। সীমান্ত পেরিয়ে তারা আসামে পাড়ি জমিয়েছেন এমন অভিযোগ থাকলেও প্রতিবেশী বাংলাদেশ জানিয়েছে, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এমন অবস্থায় ভারতে কি সৃষ্টি হবে নতুন কোনো ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতির?’ সে প্রশ্নটি সামনে আসছে সবার আগে।
এদিকে এনআরসি নিয়ে ভারতেও যে খুব সন্তুষ্টি রয়েছে তা নয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির অনেক নেতারাও নাগরিক তালিকায় ভুল-ক্রুটি রয়েছে বলে জানিয়েছেন। কেউ কেউ আবার পুরো বিষয়টি দেখছেন বিজেপি আর মোদির ‘রাজনৈতিক চাল’ হিসেবে।
এনআরসি কি?
ভারতের নাগরিক স্বীকৃতি হিসেবে পরিচিত দ্য ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস। যার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘এনআরসি’। আসামে বৈধ-অবৈধ নাগরিক শনাক্ত করতে এধরনের তথ্যভাণ্ডার করা হয়। একইধরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে নাগাল্যান্ডেও।
কেন প্রয়োজন পড়ল এনআরসির?
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর হতে হাজার হাজার বাংলাদেশি আসামে আশ্রয় নিচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে। তাই ১৯৫০ সালে আসামে কার্যকর হয় অভিবাসী আইনের। সেখানে এনআরসিকে সামনে রেখে ১৯৫১ সালে হয় প্রথম আদমশুমারি।
পরের এক দশকে আসামে স্থানীয়দের অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। সেখানে দ্রুত জনসংখ্যার ভারসাম্য (হিন্দু-মুসলিম) নষ্ট হচ্ছে এমনও দাবি করা হয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধে অনেক মুসলিম শরণার্থীও আশ্রয় নেন আসামে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরও তাদের অনেকে দেশে ফিরে আসেননি।
দাবির মুখে ১৯৭২ সালে এনআরসির হালনাগাদ হয়। তবু দানা বাঁধতে থাকে ক্ষোভ। অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএএসইউ) ও আসাম গন-সংগ্রাম পরিষদ অবৈধ বসবাসকারীদের বিতাড়িত করতে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩ সালে অবৈধ অভিবাসীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সঙ্গে বড় ধরনের দাঙ্গায় প্রায় ৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়।
১৯৯৭ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন সন্দেহভাজন অবৈধ বসবাসরতদের চিহ্নিত করতে উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট আবারও এনআরসি তথ্য তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ দেয়। এরপর ৩ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার আসামে শুরু হয় এনআরসির হালনাগাদ।
সর্বশেষ এনআরসিতে যারা যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন তারা হলেন,
- ১৯৫১ ও ১৯৭২ সালের এনআরসিতে যাদের নাম ছিল।
- ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকায় ২৪ মার্চে আগে যারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
- উপরোক্ত তালিকায় থাকাদের সন্তানেরা।
এছাড়া, যারা ১ জানুয়ারি ১৯৬৬ সালের পরে ও ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের আগে নিজেদের বৈধ শরণার্থী হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং যাদের অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন যাদের সন্দেহভাজন অবৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন তারাও এনআরসিতে জায়গা পাওয়ার সুযোগ পাবেন।
এজন্য যেসব প্রমাণাদি দাখিল করতে হচ্ছে সেগুলো হলো, পূর্বের এনআরসির ডকুমেন্টস, ভূমির কাগজপত্র, শরণার্থী রেজিস্ট্রেশন, জন্ম সনদ, কর্মক্ষেত্রের সত্যয়ন ইত্যাদি।
চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা ও বাদপড়াদের ভবিষ্যৎ
প্রথম ধাপে প্রকাশিত আসামের এনআরসি তালিকায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ১ কোটি ৯০ লাখ বসবাসকারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০১৮ সালের জুনে দ্বিতীয় দফায় প্রকাশিত তালিকায় এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি ৮৯ লাখে। সে সময় জানানো হয়েছিল রাজ্যের প্রায় ৪০ লাখ অধিবাসী এনআরসিতে জায়গা পাননি।
পর্যাপ্ত প্রমাণাদি জমা দিয়ে তৃতীয় ও চূড়ান্ত দফায় নাগরিক তালিকায় নাম নিবন্ধনের সুযোগ পান আসামের অধিবাসীরা। সর্বশেষ ৩১ আগস্ট প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় মোট ৩ কোটি ১১ লাখ ভারতীয় নাগরিকের মর্যাদা পান। অর্থাৎ বাদ পড়েছেন ১৯ লাখ আসামে বসবাসকারী।
চূড়ান্ত তালিকায় স্থান না পেলেও ১৯ লাখের কেউই এখনই অবৈধ বিদেশি বলে বিবেচিত হবেন না। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে তারা ১২০ দিনের মধ্যে আপিলের সুযোগ পাবেন। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের আইনি সহায়তার কথা জানানো হচ্ছে। এসব ট্রাইব্যুনাল যেকোনো মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন।
এরপরও সুযোগ থাকছে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের। আইনিপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছে আসামের পুলিশ প্রশাসন।
তবে আদালতের এসব জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে কজন লোক জানেন সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। তারা কতটুকু সক্ষম নিজেকে উপস্থাপন করতে তা নিয়েও সংশয় আছে। কারণ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে বোঝাপড়ার অভাবে ‘ভুল বক্তব্য’ দেওয়ায় অনেকে পূর্বেই ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এনআরসিকে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা
নাগরিক তালিকা বা এনআরসি ইস্যুতে আসামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। সহিংসতা ও বিবাদ এড়াতে বেশ কয়েকটি জেলায় ১৪৪ ধারা জারিরও ঘটনা ঘটেছে।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট হচ্ছে এনআরসি তালিকাকে ঘিরে বেড়ে চলা আত্মহত্যা। বারাক হিউমেন রাইটস প্রটেকশনের তথ্যমতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে অন্তত ৩২ জন আত্মহত্যা করেছেন তাদের ‘নাগরিকত্ব’ হারানোর আশঙ্কায়।
এধরনের তথ্যগুলো প্রথম সারির গণমাধ্যমে নিয়মতি খবর হয়ে আসে না। তাই আত্মহত্যায় মৃতদের মধ্যে যে ১৬টি ঘটনা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে তাদের অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও বাঙালি।
এনআরসিকে ভর করে ভারতীয় রাজনীতি
সম্প্রতি ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগেও বিজেপি সরকার এনআরসি নিয়ে সরব হয়েছিল। নাগরিক তথ্য লিপিবদ্ধ করার কথা জানানো হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গেও। আর এসবের লক্ষ্যবস্তু ছিল ‘অবৈধ মুসলিমদের বিরুদ্ধে’ রব তুলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী হিন্দুদের ভোট আদায় করা। তবে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা শেষে অনেক বিজেপি নেতাও তালিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ অনেক হিন্দুদের নামও তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। যা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
আসামে বিজেপি প্রেসিডেন্ট রঞ্জিত কুমার দাস বলেন, অনেক ভারতীয়রা বাদ পড়েছে। যারা উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরা থেকে এসেছে কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তারা বাদ পড়েছে।
বিজেপির এমএলএ দিলীপ কুমার পাল বলেন, অনেক বাংলাদেশি মুসলমানের নাম তালিকায় এসেছে। বিপরীতে হিন্দু ভারতীয়র নাম বাদ গেছে। হিন্দুরা ভারতে কখনো বিদেশি হতে পারে না।
এদিকে আসামের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও দেখছেন সবকিছু রাজনৈতিক চাল হিসেবে। তালিকা ত্রুটিযুক্ত ও ভারতীয়রা বাদ পড়ছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ লাগোয়া জেলা দক্ষিণ সালমারা ও ধুবুরিতে তালিকা থেকে বাদ পড়ার হার সর্বনিম্ন। অথচ ভূমিপুত্র জেলায় প্রচুর মানুষের নাম বাদ পড়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব? আমরা এই তালিকায় ভরসা রাখছি না। বিজেপির আমলে এমন আরও অনেক ফাইনাল দেখা যাবে।
ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসও বলেছে, ভাষাভাষী ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে বহু প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক আসামের নাগরিক তালিকা (এনআরসি) থেকে বাদ পড়েছে। তাদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনআরসিকে ব্যর্থ নাটকীয়তা বলে উল্লেখ করেছেন। টুইটে তিনি লেখেন, নাগরিক তালিকা নিয়ে যারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছিল, তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে এনআরসি। দেশকে জবাব দিতে হবে তাদের। দেশ ও সমাজের স্বার্থ পরিহার করে অসৎ উদ্দেশ্যে কাজ করলে এমনটাই ঘটে।
কি ভাবছে বাংলাদেশ? টার্গেট কি মুসলিমরা?
আসামে এনআরসি’র লক্ষ্য ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ উচ্ছেদ। একথা বলা হলেও বাংলাদেশ এনআরসিকে ভাবছে ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা হবে না।
১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাভারে নতজানু বাংলাদেশ আসামের ‘অবৈধদের’ দায়িত্ব নেবে না। এবং ভারত এ বিষয়ে জোরাজুরি করলে দুদেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই স্বাভাবিক। যদিও এর আগে, বিজেপির বেশ কয়েকজন নেতা হুংকার ছেড়েছিলেন আসামে ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ ফেরত পাঠানো হবে; তবে তা কতটুকু সম্ভব তা সময় বলে দেবে।
এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম আসার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ছাপিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম। সেসব খবরে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও মুসলিম বিদ্বেষের অভিযোগের বিষয় উঠে এসেছে। অপরদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলছেন মুসলিম নিধনের অংশ হিসেবেই মোদি সরকারের আসামে এনআরসি বাস্তবায়ন করছেন।
আসামে কি সৃষ্টি হবে ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি?’
মিয়ারমারে সেনা নির্যাতনের শিকার ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে জোরপূর্বক এসব বাস্তুচ্যুতের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। আসামে এনআরসিতে যারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না; তাদেরও কপালে কি আছে তাও বলা যাচ্ছে না। জোরপূর্বক আসামের ‘অবৈধ বসবাসকারীদের’ হটানো সম্ভব না হলে ক্যাম্প করে তাদের নজরবন্দি করে রাখার সম্ভাবনাও রয়েছে। তাহলে যে প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক তা হলো, ভারত কি নিজের দেশের অভ্যন্তরেই সৃষ্টি করছে ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি?’
সংবাদে ব্যবহৃত তথ্যসমূহ উইকিপিডিয়া, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, এনডিটিভি ও ফার্স্টপোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে।