পাঠাওচালক মিলন খুন: ৫০ টাকায় মোটরসাইকেল ভাড়া করে ‘খুনি’ সুমন
২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:১৭
ঢাকা: রাজধানীর মালিবাগ ফ্লাইওভারে পাঠাও চালক মিলন মিয়াকে ছুরিকাঘাতে খুনের ঘটনায় ছিনতাইকারী মো. সুমনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জানিয়েছেন, মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের উদ্দেশে ৫০ টাকায় গুলিস্তানে যাওয়ার জন্য মিলনের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন সুমন। মোটরসাইকেল ফ্লাইওভারে ওঠার পর নির্জন জায়গা বুঝে মিলনের গলায় ছুরিকাঘাত করেন ছিনতাইকারী।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
আবদুল বাতেন জানান, গভীর রাতে বাইক আরোহী নিয়ে নির্জন ফ্লাইওভারে ওঠার কারণেই নির্মমভাবে খুন হতে হয় পাঠাও চালক মিলনকে। রাত আড়াইটার দিকে পাঠাও চালক মিলন যদি তিন তলা ফ্লাইওভারে না উঠে নিচ দিয়ে যেতেন তাহলে হয়ত তাকে খুন হতে হতো না। কারণ রাতের বেলা নিচের সড়কে লোকজন থাকে।
পাঠাও চালক মিলন হত্যার একমাত্র আসামি নুরুদ্দিন সুমন ওরফে নুরুজ্জামান অপুকে (৩০) রাজধানীর শাহজাহানপুর গুলবাগ থেকে রোববার রাত ১২টার দিকে গ্রেফতার করা হয়। এর সময় তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ছিনতাই হওয়া ডায়াং-১৫০ মোটরসাইকেল ও স্যামসাং মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়।
আবদুল বাতেন বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশের (পুর্ব) মতিঝিল জোনাল টিমের কর্মকর্তারা তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জানতে পারে, আসামি নুরুদ্দিন সুমন গুলবাগে অবস্থান করছে। এরপর সেখানে অভিযান চালিয়ে সুমনকে গ্রেফতার করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সুমন পাঠাওচালক মিলনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। আজ তাকে আদালতে পাঠানো হবে। আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার কথা রয়েছে সুমনের।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, পাঠাও চালক মিলন প্রথমে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার থেকে ১০০ টাকা চুক্তিতে একজন আরোহীকে মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় নামিয়ে দেন। এরপর বন্ধুর সঙ্গে সদরঘাটে সাক্ষাৎ করার কথা ছিল তাই মিলন ফ্লাইওভার দিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেই গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
আবুল হোটেলের সামনে এলে নুরুদ্দিন সুমন মিলনকে জানায়, ‘আমি গুলিস্তানে যাব, নিয়ে যান।’ পঞ্চাশ টাকায় তাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দেওয়ার জন্য চুক্তি করে মোটরসাইকেলে তোলেন।
মৌচাক-মালিবাগ মোড়ের নেওয়ার সময় সুমন পাঠাও চালক মিলনকে জানায়, ভাই একটু গাড়িটা থামান, সিগারেট ধরাব। তার কথায় তিনি তিন তলা ফ্লাইওভারে গাড়ি থামান। সুমন দিয়াশলাইটি ফেলে দিয়ে কুড়িয়ে আনতে বলেন। দিয়াশলাই কুড়াতে গেলে এই ফাঁকে সুমন মোটরসাইকেলে বসে।
সুমন জানায়, আমি মোটরসাইকেল চালাব, আপনি পেছনে বসেন। এরপর দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে সুমন, মিলনের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয় এবং মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সুমন গোয়েন্দাদের বলেন, ‘মিলন বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করছিল। এই অবস্থায় আমি শাহজাহানপুর সড়কের দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যাই। মিলন যে মারা গেছে, তা আমি জানি না। কোনো খোঁজ খবর নেই ভেবে নিশ্চিন্তে ছিলাম।’
কীভাবে আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হলো জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ ক্লুলেস মার্ডার ছিল। যার সিসিটিভি ফুটেজে কিছু দেখা যায়নি। পাঠাওয়ের অ্যাপস ব্যবহার করা হয়নি, মোবাইল ফোনটিও নিয়ে যায়। এই ঘটনাটি ডিটেক্ট করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এরপরও আমাদের চৌকস কর্মকর্তারা রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার আতিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছিনতাই হওয়া মিলনের মোবাইল ফোনটি সুমন একজন নাইটগার্ডের কাছে বিক্রি করেন। তার নাম মোশারফ হোসেন। মোশারফ মোবাইলটি আড়াই হাজার টাকায় কেনেন। ওই মোবাইলে নতুন সিম তুলে চালাচ্ছিলেন মোশারফ। কল লিস্টের সূত্র ধরে মোবাইলের আইএমই নম্বর পাওয়া যায়। ওইদিন ওই এলাকায় যতগুলো কলার ছিল তার সবগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। প্রথমে মোশাররফকে ধরলে তিনি সুমনের খোঁজ দেন।
এরপর গতরাতে সুমনকে গুলবাগ থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় তার বাসা থেকে ৯টি হেলমেট পাওয়া যায়। অথচ তার কোনো গাড়ি নেই।’
এডিসি আতিক আরও বলেন, ‘মোটরসাইকেলটি একটি নির্মাণাধীন ভবনের নিচে রাখা হয়েছিল। কয়েকদিন পরেই মোটরসাইকেলটি বিক্রি করা হতো। কয়েকজনের সঙ্গে বিক্রির আলাপ আলোচনাও করেছিল। একজন ৪০ হাজার টাকা দাম বলেছিল। এর আগে, মতিঝিলের একটি ছিনতাই মামলায় সুমন জেলও খেটেছে বলে জানিয়েছে। তবে ওই মামলার এখনো বিস্তারিত পাওয়া যায়নি।’
অন্ধকার ফ্লাইওভারে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘ডিএমপির পক্ষ থেকে ফ্লাইওভারের মাথায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। পুরো দায় তো পুলিশের ওপর চাপালে হবে না। এটির দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তারা অন্ধকারে রাখবে নাকি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাবে সেটা তাদের ব্যাপার।’
গত ২৬ আগস্ট ছুরিকাঘাতের শিকার হন পাঠাও চালাও মিলন মিয়া। ছিনতাইকারী মোটর সাইকেল নিয়ে পালিয়ে গেলে জীবন বাঁচাতে জখম গলা চেপে ধরে ফ্লাইওভারের শান্তিনগর অংশে নেমে আসেন মিলন। ঢাকা মেডিকেলে অস্ত্রোপচার শেষে মিলনকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেখানে মিলনের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন
পাঠাওচালক হত্যাকারী নজরদারিতে, যে কোনো সময় গ্রেফতার
পাঠাওচালককে হত্যা; সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে মাঠে গোয়েন্দারা
মিলনের দুই চোখে সেদিন ছিল বাঁচার আকুতি
মালিবাগ ফ্লাইওভারে ‘পাঠাও’ চালককে গলাকেটে হত্যা