জামিনে বেরিয়েই ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কারের উদ্যোগ মালিকের
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২৩:৩৪
ঢাকা: চকবাজারের চুড়িহাট্টার সেই ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় প্রাণহানির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন ভাড়া দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিলেন ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক হাসান ও সোহেল। ছয় মাসের মাথাতেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তারা। আর মুক্তি পেয়েই তারা আগুনে পোড়া পরিত্যক্ত সেই ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এলাকাবাসী কোনোভাবেই ভবনটি সংস্কার করতে দিতে চান না।
এলাকাবাসীর দাবি, পরিত্যাক্ত ভবনটি ভেঙে ফেলে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হোক। এ ক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশনের জোরালো ভূমিকা দেখতে চান তারা।
আরও পড়ুন- বিধ্বস্ত-ভুতুড়ে চুড়িহাট্টা; এক মাসেও ফেরেনি প্রাণের স্পন্দন
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, ভবন সংস্কারের প্রস্তুতি চলছে। আর স্থানীয়রা জানালেন, এর আগে একাধিকবার তারা সংস্কারের উদ্যোগ থামিয়েছেন। এবার মালিকরা জামিনে বেরিয়ে আসার পর তাদের থামানো যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
ওয়াহেদ ম্যানশনে বসেছে অস্থায়ী দোকান
এলাকাবাসী বলছেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক হাসান ও সোহেল জেলে যাওয়ার পর সোহেলের শ্যালক রুবেল গত জুন মাসের দিকে ভবনটি সংস্কারের কাজ শুরু করে। এতে এলাকাবাসী প্রথমে বাধা দিলে তারা সিটি করপোরেশনের একটি অনুমতির কাগজ দেখিয়ে সংস্কার কাজ চালিয়ে যায়। পরে ওই কাগজটি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটি স্থায়ীভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে বুয়েটের টিম সরেজমিনে আসবে। সেজন্য ভবনের পোড়া জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে একটি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছিল। অথচ সেটি দেখিয়েই তারা সংস্কার কাজ শুরু করে। এলাকাবাসী বিষয়টি রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে অবহিত করলে রাজউকের পক্ষ থেকে লোক পাঠিয়ে সংস্কার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্থানীয়রা বলেন, আমরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সংস্কার করতে দিতে চাই না। ভবনটি এখনই নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। আর প্রাণহানি চাই না আমরা। এক চুড়িহাট্টার কারণে এই এলাকা এখনো শ্মশানে পরিণত হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, হাসান ও সোহেল জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে। বের হয়েই তারা অনেকের কাছে বলেছে, তারা ভবন সংস্কার করবে।
ভেতরে চলছে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ
সরেজমিনে দেখা যায়, এরই মধ্যে ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলার অন্তত ১০টি দোকান নতুন করে সিমেন্ট, বালু ও ইট দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। দোকানও বসেছে কয়েকটি। ভেতরের দোকানগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজও চলছে। ভবনটির দ্বিতীয় তলার একটি অংশের দেয়াল বিস্ফোরণে ছিটকে গিয়েছিল সেই অংশ সংস্কার করার জন্যও রাখা হয়েছে বাড়তি ইট।
সংস্কার করা দোকানে সবজির দোকান বসিয়েছেন মোস্তফা কামাল মিন্টু। তিনি বলেন, আগে ফুটপাতে ভ্যানে সবজি বিক্রি করতাম। সোহেলের শ্যালক রুবেলের কথায় এই দোকানে বসেছি। আপাতত মাসে ৫০০ টাকা ভাড়া দিতেছি। পরে তারা অন্য কাউকে ভাড়া দেবেন।
এই ভবন তো ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত, ঝুঁকি নিয়েও কেন দোকান বসিয়েছেন— জানতে চাইলে মিন্টু বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ তো আমরাও জানি। রাজউক এসে বলে গেছে, কেউ যেন এখানে কাজ করতে না পারে। এরপরও তো কাজ করছে মালিক। তারা নাকি অনুমতি পেয়েছে।
ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপরীত দিকের পরিত্যক্ত ভবন রাজ্জাক ম্যানশনের নিচে অস্থায়ীভাবে ফলের দোকান বসিয়েছেন আবুল কালাম। আগে ওষুধের ফার্মেসির সামনেই ভ্যানে ফল বিক্রি করতেন। আগুনের ঘটনার দিন বিকেলেই গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে গিয়েছিলেন। যার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন। আগুনের ঘটনার কয়েক মাস পর তিনি রাজ্জাক ম্যানশনের পরিত্যক্ত দোকান পরিষ্কার করে অস্থায়ী দোকান শুরু করেন।
ভবন সংস্কারের জন্য এনে রাখা হয়েছে ইট
আবুল কালাম সারাবাংলাকে বলেন, রাজ্জাক ম্যানশন ভেঙে নতুন করে ভবন করবেন বলে জানিয়েছেন মালিক। তাই এখানে আপাতত আছি। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশন বারবার সংস্কার করার পাঁয়তারা চলছে। হাসান ও সোহেল বের হয়েই দেখলাম সংস্কার করার জন্য বলাবলি করছে। আগে যারা ভাড়া ছিলেন, তাদের আবারও ভাড়া দেওয়ার চিন্তা করছে। অনেক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথাও বলেছে। কোনো কোনো ভাড়াটিয়া সংস্কার করার জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়েছেন বলে শুনেছি।
এ ব্যাপারে কথা বলতে হাসান ও সোহেলের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেও তাদের দেখা পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কথা হয় সোহেলের শ্যালক রুবেলের সঙ্গে।
রুবেল সারাবাংলাকে বলেন, আগুনের কারণে ওয়াহেদ ম্যানশন শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হয়নি, আশপাশের অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পাশের যে দুই তলা ভবনটি ছিল, সেটি তো পুড়ে গিয়ে ঝুরঝুরে অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটাই সংস্কারের পর এখন ভালো ভবনে পরিণত হয়েছে। কর্ণফুলি হোটেল ও রাজমহল হোটেলও সংস্কার করে দোকান চালু করেছে। আর আমরা করলেই সমস্যা?
আগুনে মালামাল পুড়ে গেছে বলে কি কলাম আর ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে?— প্রশ্ন করেন রুবেল।
বিধ্বস্ত ওয়াহেন ম্যানসন
ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের অথরাইজড অফিসার নুরুজ্জামান জহির সারাবাংলাকে বলেন, ভবনটিতে কেমিক্যাল থাকায় আগুন লাগার পর বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে ভবনটির। সেটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরপরও জানতে পেরেছি সেখানে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা তদারকিতে আছি, যেন কেউ সংস্কার কাজ করতে না পারে। ভূমিকম্পসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভবনটি ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চূড়ান্তভাবে ভবন ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের কাজ বন্ধ থাকবে।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) কবির হোসেন হাওলাদার বলেন, আদালত হাসান ও সোহেলকে ২১ আগস্ট জামিন দেন। গত ২২ আগস্ট তারা মুক্তি পান জেল থেকে। গত ২৯ আগস্ট আদালতে তাদের হাজিরা ছিল। আদালতে তারা হাজিরাও দেন। তবে তারা বের হয়ে ভবন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে কি না, সে বিষয়ে কিছু জানি না।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার এই ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুনে ঝড়ে যায় ৭১ জন মানুষের প্রাণ। এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজউক, আইইবি, বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস ও বুয়েটের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশে ওয়াহেদ ম্যানশন ও রাজ্জাক ম্যানশনকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ভবন ব্যবহার করা যাবে কি না, আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর চূড়ান্ত অনুমতি দেওয়ার কথা রয়েছে।
ওয়াহেদ ম্যানশন ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক চকবাজারের চুড়িহাট্টা চুড়িহাট্টা চুড়িহাট্টার আগুন জামিনে মুক্ত পরিত্যক্ত ভবন ভবন সংস্কার সংস্কার সংস্কারের উদ্যোগ