এরশাদের পর খালেদা
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২০:০৬
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পর বিএনপির চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে দুর্নীতির দায় নিয়ে কারাগারে যেতে হল।
দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছর সাজা দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়াকে নিয়ে যাওয়া হল পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান এই রায় দেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়া বন্দি হয়েছেন বেশ কয়েকবার। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের আমলে এক বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এবারই প্রথম আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যেতে হল তাকে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেফতার হন খালেদা জিয়া। তখন তাকে সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাড়িতে গৃহবন্দি রাখা হয়।
সর্বশেষ জরুরি অবস্থার সময় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন খালেদা জিয়া। প্রায় ১ বছর ৭ দিন সংসদ ভবনের একটি বাড়িতে বন্দি রাখা হয় তাকে। পাশের বাড়িতে বন্দি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই সময় খালেদার দুই ছেলে তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোও গ্রেফতার হন। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খালেদা জামিনে মুক্তি পান।
তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো জামিনে মুক্তি নিয়ে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য। মুদ্রা পাচারে এক মামলায় দণ্ড নিয়ে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত অবস্থায় ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মারা যান আরাফাত রহমান কোকো। মুদ্রা পাচারের আরেক মামলায় সাজা নিয়ে সপরিবারে লন্ডনে রয়েছেন তারেক রহমান।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর দলের হাল ধরেন খালেদা জিয়া।
প্রথমে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হন তিনি। এক বছর পর ১৯৮৪ সালে নেন চেয়ারপারসনের দায়িত্ব। এরপর টানা ৩৪ বছর ধরে একই দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
ওয়ান ইলেভেনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
তবে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে তিনিই দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। বড় ছেলে তারেক রহমান নির্বাচিত হন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। যিনি খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করবেন।
১৯৯১ সালের পর অনুষ্ঠিত অংশগ্রহণমূলক চারটি নির্বাচনে যতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, ততটিতেই জয়ী হয়েছেন খালেদা জিয়া। কোনো নির্বাচনে হারেননি তিনি। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মুসলিম বিশ্বেও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।
১৯৯৬ সাল থেকে পাঁচ বছর বিরোধীদলীয় নেতা থাকার পর ২০০১ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ফের প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।
ওই শাসনামলেই ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হয়ে ওঠেন ছেলে তারেক রহমান। জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধা ও সন্তানস্নেহের কাছে নৈতিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়ায় খালেদা জিয়াকে আজকের পরিণতি বরণ করতে হল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, জামায়াত সম্পৃক্তা ও পুত্রস্নেহে অন্ধ হওয়ার কারণেই এক সময়ের আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া রাজনীতির শেষ দেড় দশক অনেক কিছুর সঙ্গেই আপস করেছেন। এর মাসুল দিতে হয়েছে তাকে।
২০১০ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের বাসা থেকে উৎখাত হতে হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার পর দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় সরকার ও সংসদের বাইরে রয়েছেন গত চার বছর ধরে।
২০১৪ সালে ভোট ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পরের বছর সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেও ব্যর্থ হন খালেদা জিয়া। অনির্দিষ্টকালের হরতাল অবরোধ ডেকে টানা তিন মাস নিজ কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় বন্দি জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায় হয়েছে। চলছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলাও। আরও কয়েকটি দুর্নীতির মামলা রয়েছে খালেদার বিরুদ্ধে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সেগুলোরও রায় হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।
খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালে। পিতা ইস্কান্দর মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদারের ঘরে জন্ম নেওয়া খালেদা জিয়ার অন্তত তিনটি জন্মদিনের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার দিনটিতে তার একটি জন্মদিন রয়েছে। যেটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সারাবংলা/এজেড/এমএ