সড়কে গেলো প্রাণ, মায়ের দুধের জন্য রাতভর কাঁদে ইসরা
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:৩২
ঢাকা: ‘রাত ১২ টায় -ঘুমের মধ্যেই কেঁদে ওঠে ইসরা। ফিডার মুখে ধরলাম, এক ঝটকায় মুখ থেকে ফেলে দিয়ে কান্না শুরু করল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাকে খুঁজতে থাকে আর কাঁদে। ঘণ্টাখানেক কেঁদে ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আবারও রাত চারটায় জেগে ওঠে। একইভাবে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে পরে ঘুমিয়ে যায়। কিভাবে সামলাবো এই দুধের বাচ্চাটিকে? এতো কষ্ট কেমনে সহ্য করব? কিভাবে সহ্য করবে আমার ছেলে। দুইদিন ধরে কিছুই খায়নি। বিছানায় লেপ্টে পড়ে আছে।’
বৃহস্পতিবার মহাখালীতে বাসচাপায় মারা যাওয়া ফারহানাজের ১৫ মাস বয়সী ইসরাকে কোলে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আর ডুকরে কাঁদছিলেন দাদি জাহিদা আখতার রেনু।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে সারাবাংলার এই প্রতিবেদক যখন মিরপুরের মনিপুরে ফারহানাজের শ্বশুরবাড়িতে, তখন ঘরভর্তি স্বজন আর প্রতিবেশীর ভিড়। শোবার ঘরের বিছানার এককোণে শুয়ে ফারহানাজের স্বামী পাভেল। রাতে স্যালাইন পুশ করে আর ভোরে ঘুমের ওষুধে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
ফারহানাজ-পাভেলের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটিকে ঘিরে চলছে কান্নার রোল। দাদি-নানি-খালা সবাই মিলে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সবার চোখেই পানি। কেউ কাঁদছেন নিঃশব্দে কেউ হাউমাউ করে। ইসরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আবার আপনমনে খেলা শুরু করে।
ফারহানাজের শাশুড়ি জাহিদা আখতার রেনু বলেন, আমার মেয়ে নেই। দুইটাই ছেলে। ফারহানাজ আমার নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি ছিল। কখনোই মনে হতো না ও আমার ছেলের বউ। আামার ঘরটা আলো করে রাখত। পুরো বাড়িজুড়ে ওর স্মৃতি। এতো সুন্দর যে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এতো ভালো ব্যবহার যে আত্বীয়রা বলত তোমার বউ ভাগ্য খুব ভালো। সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকতো। বৃহস্পতিবার অফিস যাবার সময় বলে গেল ‘ আম্মু আসি’। ওই শেষ কথা-কান্নায় ভেঙে পড়েন রেণু।
আরও পড়ুন: অফিস যাওয়ার পথে বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল ফারহানাজের
চোখ মুছে আবারও বলা শুরু করেন— ‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবা-মা একমাথে বাসায় ফিরত। তাই দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ পেলেই অস্থির হয়ে আমাকে ঠেলত। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তো ইসরা। আমি ওর মায়ের ব্যাগটা তখন হাতে নিতাম। সারাদিন আমার কাছে থাকলেও ওর মা এলে আর আমার কাছে আসতো না। মায়ের গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকত। বাথরুমেও যেতে দিত না। ’
ফারাহানাজের মা শাহজাদী বেগম জানালেন তা মেয়েটি খুব মেধাবী ছিল। সব সময় ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতো ফারহা। ঢাকার সিটি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে ইডেন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছে আমার মেয়ে। ব্যাংক কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল। সব শেষ হয়ে গেল। যে বাসচালক আমার মেয়েকে মেরে ফেলছে তাকেও এমন করে পিষে মারা হোক। আমার কলিজা জ্বলে যাচ্ছে। কিভাবে ঠান্ডা করবো? আমার নাতনির কী হবে?’
কান্না ছাড়া আর কোনো শব্দ বেরোয় না তার শাহজাদী বেগমের কণ্ঠ থেকে। তার এই কান্নার রেশ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঘরের সবার মাঝে। ছোট্ট ইসরা অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শাহজাদী বেগম বলেন, আমার মেয়ের তো কোনো দোষ নেই । ও তো রাস্তা পারাপারের সময় বাস ধাক্কা দেয়নি। ও নাকি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার তরতাজা মেয়েটারে মেরে ফেলল।
ইসরার বাবার বড় ভাই মোহাম্মদ সাইফুল রাসেল জানান, তার ছোট ভাই পাভেল তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর কিছুই খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না। কবরস্থানে যেতে চাচ্ছে বারবার। কিন্তু তার হাঁটারও ক্ষমতা নেই। আজ সকালে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হইছে। ওর মেয়েটা এতোদিন কোনো কথায় বলতো না। গতকাল থেকে কান্নার সময় ‘মা’ -‘মা’ করছে।
বৃহস্পতিবারের ওই বাস দুর্ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী চ্যানেল টোয়েন্টটি ফোরের স্টাফ রির্পোটার জেড এম সাদ। ওইদিন ঘাতক বাসটির ঠিক পেছনেই অফিসের গাড়িতে ছিলেন তিনি।
আসলে কী ঘটেছিল সেদিন জানতে চাইলে সাদ বলেন, আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল গাজীপুরের মাওনাতে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে পৌনে ৯টার মতো হবে । বনানীর শেষ মাথায় যেখানে ফ্লাইওভারের ঢাল শেষে হয়েছে অর্থাৎ আমতলীতে হঠাৎ দেখলাম একটা বাসের সামনের অংশ উঠে গেল ফুটপাতে। বাসটির পেছনে আরেকটি গাড়ির পেছনে আমাদের গাড়িটা। সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। নেমে দেখি একজন বাইকসহ রাস্তায় পড়ে আছে। তিনি পুরুষ ও কম আহত। অন্যজন নারী, ফুটপাতের উপরে তার শরীরের অর্ধেকটা আর নিচের অংশটা রাস্তায়। তিনি ব্যর্থায় গোঙ্গাচ্ছেন।
ঘাতক বাসটিতে যাত্রী ছিল না। দেখলাম বাসচালক নেমে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। আমি দেখলাম মেয়েটি বেঁচে আছে। কিন্তু তার কন্ডিশন খুব খারাপ। পথচারী এক আপুৃর সহযোগিতায় আমি ও আমার ভিডিওগ্রাফার তাকে গাড়িতে উঠায়। আমি তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে যাই— যেন উনি জ্ঞান না হারান। তখনো তিনি ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছেন। কিন্তু তার চোখ খোলা। আমার কোলেই ছিল তার মাথাটা। কোথাও তেমন কোনো ব্লিডিং নেই। পরে পত্রিকায় দেখেছি তার মাথা ফেটেছি। কিন্তু আসলে তার মাথা বা শরীরের কোনো অংশে ফাটা বা রক্ত ছিল না। হালকা আঁচড়ে গিয়েছিল কয়েকটি জায়গায়। হয়তো শরীরের ভেতরে রক্তরক্ষণ হয়েছিল।
কিছুক্ষণ পরে আমি তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে মোবাইল বের করি, তার পরিবার-পরিচিতদের দুর্ঘটনার বিষয়ে জানাবো বলে। কিন্তু ফোনটা পার্সওয়ার্ড লকড ছিল। পরে ব্যাগে পাওয়া আইডি কার্ড থেকে ফোন নম্বর নিয়ে তার অফিসে ফোন করে জানালাম, তিনি অ্যাকসিডেন্ট করেছেন। তাকে আমরা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিচ্ছি।
সাদ বলেন, যানজট কম থাকায় মিনিটি বিশেকের মধ্যেই আমরা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছে যাই। কিন্তু সেখানকার ইর্মাজেন্সি গেটে কোনো আয়া বা স্ট্রেচার ছিল না। ছিল শুধু একটা হুইল চেয়ার । ডিউটিতে থাকা আনসার বললো, এখানে লোকবল কম, স্ট্রেচার নিজেদের আনতে হবে। আমাদের ড্রাইভারকে পাঠিয়ে ভেতর থেকে স্ট্রেচার আনালাম। পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনদের অনুরোধ করলাম— তাকে গাড়ি থেকে নামাতে সাহায্য করতে। গাড়িতে থাকা অপরিচত সেই পথচারী আপু আর আমি নামানোর সময় বুঝতে পারলাম, তিনি বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
আমরা ক’জনে কিছুতেই গাড়ি থেকে তার শরীরটা বের করতে পারছিলাম না। কিন্ত কেউ সাহায্যে এগিয়ে এলো না। পরে কোনো মতে তাকে নামিয়ে ইর্মাজেন্সিতে নেওয়ার পর ইসিজি করে ডাক্তার বললেন— শেষ , আর কিছু করার নেই।
আমি কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট বাদ দিয়ে, এই ঘটনা নিয়ে নিউজ করার কথা ভুলে শুধুই তাকে বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু হাসপাতালে আমাদের ১০ মিনিটেরও বেশি সময় নষ্ট হয়েছে, কেউ এগিয়ে আসেনি। হাসপাতালের সহযোগিতাও পাইনি। এটা পীড়াদায়ক, বলেন জেড এম সাদ।