গৃহকর্মী সুরক্ষায় অক্সফামের নতুন কর্মসূচি
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:১০
ঢাকা: নারী গৃহকর্মীদের নির্যাতন বন্ধ ও সুরক্ষা দিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম নতুন কর্মসূচির উদ্বোধন করেছে। এর মাধ্যমে গৃহকর্মীদের অধিকার আদায়, প্রশিক্ষণ, আইনি সুরক্ষা এবং নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হবে। গড়ে তোলা হবে সামাজিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড। অক্সফামের সহয়োগী সংগঠন হিসেবে থাকছে নারী মৈত্রী, ক্যাম্পি, ইউসেফ, পিসিএস, বিলস এবং রেড অরেঞ্জ।
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অক্সফামের নতুন এ কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে একটি জাতীয় সংলাপও অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংলাপে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, কানাডিয়ান হাই কমিশনার, সংসদ সদস্য এবং গৃহকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
অক্সফামের নতুন কর্মসূচি ব্যবস্থাপক গীতা অধিকারী বলেন, ‘গৃহকর্মীরা এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে আছে। তাদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। আয়ের নির্দিষ্ট সীমা নেই। আইনি সুরক্ষাও তেমন নেই। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে গৃহকর্মীদের বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করা হবে। নির্যাতন বন্ধে সামাজিক আন্দোলনসহ সবধরনের কাজ করা হবে। সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে গৃহকর্মীদের অধিকার আদায়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করা হবে।’
গীতা অধিকারী বলেন, ‘গৃহকর্মী একজন শ্রমিক। সে শ্রমিকের মূল্যায়নটুকু যেন পায় তা নিয়ে কাজ করা হবে। শ্রমিকের অধিকার, আইনি অধিকার, পেশার মর্যাদা এবং সুরক্ষা যেন পায় সে জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, অদূর ভবিষ্যতে একটি ভালো গৃহকর্মীসূলভ বাংলাদেশ দেখতে পারবে।’
অক্সফাম বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর দীপঙ্কর দত্ত বলেন, ‘গৃহকর্মীদের সহযোগিতা করা হবে, যেন তারা সুন্দরভাবে কাজ করতে পারে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেন তারা দক্ষ হতে পারে। কাজ ভালো না লাগলে যেন অন্য জায়গায় কাজে যোগ দিতে পারে, স্বাধীনভঅবে কাজ করতে পারে। তাদের মানসিকভাবে দক্ষ করে তোলা হবে।’
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের গৃহকর্মীরা সামান্য বেতনে কাজ করেন। তাদের কোনো বেতন কাঠামো নেই। তাদের নোংরা পরিবেশে থাকতে দেওয়া হয়। নিয়মিত খেতে দেওয়া হয় না। দিলেও পচা ও বাসি খাবার খেতে দেওয়া হয়। ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকতে হয়। যার ফলে তারা ঠিকমতো কাজকর্মও করতে পারে না। তাদের যৌন হয়রানি করা হয়। এছাড়া বিভিন্নভাবে নারী গৃহকর্মীদের নির্যাতন করা হয়ে থাকে।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য ইসরাফী আলম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শ্রমিক আইন থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে গৃহকর্মীদের জন্য কোনো আইন ছিল না। ২০১৫ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা হলেও সেটি এখনো আইনে পরিণত হয়নি। এখানে গৃহকর্মীরা কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করে। যার ফলে কেউ পাঁচ হাজার আবার কেউ তিন হাজার টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন। আমাদের শ্রমিক আইন মোটামুটি ভালো হলেও গৃহকর্মী আইন সে পর্যায়ে যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘তার বাসায় গৃহকর্মীর জন্য আলাদা কোনো ডাইনিং টেবিল নেই, ঘুমানোর জন্য আলাদা কক্ষ নেই কিংবা আলাদা কোনো বাথরুম নেই। আমরা যে টেবিলে খাই, যেখাটে ঘুমাই এবং যে বাথরুম ব্যবহার করি গৃহকর্মীরাও তাই ব্যবহার করে। সবার জন্য সমান অধিকার রয়েছে তার বাসায়।’
ইসরাফী আলম বলেন, ‘এটি প্রতিটি মানসিক ব্যাপার। এটি আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এটি কাউকে জোর করে করানো সম্ভব নয়। গৃহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য স্ব স্ব জায়গা থেকে সহায়তা করতে হবে। গৃহকর্মীদের বেশি বেশি প্রশিক্ষণ এবং আইন সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কানাডিয়ান হাইকমিশনার ত্রিনা ওভিদো (Trina Oviedo) বলেন, ‘বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমরা সবসময় পাশে থাকব। বাংলাদেশ অচিরেই একটি ভালো অবস্থা দেখতে পারবে। আর যতই আইন ও নীতিমালার কথা বলি না কেন? যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা গৃহকর্মীদের প্রতি সম্মান না করব এবং মর্যাদা না দেবো ততক্ষণ পর্যন্ত গৃহকর্মীরা সুরক্ষা পাবে না।’
অনুষ্ঠানে গৃহকর্মীদের মধ্যে থেকে কথা বলেন, মোহাম্মদপুর রায়েরবাগ থেকে আসা গৃহকর্মী রাহেলা। চার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকেন। স্বামী আরেকটি বিয়ে করে অন্য জায়গায় থাকেন। পরিবারের খোঁজ-খবর নেয় না। চারবছর ধরে তিনি গৃহকর্মী হিসেবে বিভিন্ন বাসায় কাজ করছেন। অনেক নির্যাতিত হয়েছেন। এখন তিনি তিনটি বাড়িতে ঘণ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিন বাসা মিলে টাকা পান ৮ হাজার টাকা। এতেও দিন চলে না। কেউ খাবার দিতে চায় না। আবার কেউ দিলেও তা বাসি খাবার দেন।
রাহেলা বলেন, ‘যে ভবনে কাজ করি সেখানে লিফটে উঠতে দেন না। অনেকে গায়ে হাত না দিলেও নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করেন। নানা অসুবিধার মধ্যে গৃহকর্মীরা আমরা কাজ করে থাকি। তাই আপনারা এগিয়ে এসেছেন আমাদের উন্নয়নে, এতে আমরা খুশি। আমাদের নিরাপদ কর্ম পরিবেশ যেন হয় এবং বেতনটা যেন একটু বাড়ে এটিই চাই।’
অন্যদিকে গৃহকর্মী সরবরাহকারী অ্যাপসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হ্যালো টাচ থেকে এসেছেন শাহনাজ পারভীন। তিনি ধানমন্ডিতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর গ্রাম থেকে দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে এক চাচির সঙ্গে ঢাকায় আসি। অনেক বাড়িতে কাজ করেছি। নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি। একটি সময় গেছে খেতেও পারিনি। এখন হ্যালো টাচের সঙ্গ কাজ করছি। বেতন আগের চেয়ে দ্বিগুণ পাই। নিরাপত্তা ও সুরক্ষা আছে রেশন পাই। সবমিলিয়ে ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শিখাইতেছি। এভাবে সব গৃহকর্মীদের যদি এক জায়গায় আনা যেত তাহলে খুব ভালো হতো।’