প্রধান শিক্ষকের যৌন হয়রানির ভয়ে স্কুলে যাচ্ছে না ছাত্রীরা!
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:৪৫
বরগুনা: স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী। পরিবারের সদস্যরা এসব ছাত্রীদের স্কুলে পাঠানো নিরাপদ মনে করছেন না। আর তাদের এই নিরাপত্তাহীনতার কারণ স্বয়ং ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিমের বিরুদ্ধে উঠেছে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ। স্কুলটির অন্তত ২০ জন ছাত্রীকে তিনি হয়রানি করেছেন বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে।
অবশ্য এই ধরনের অভিযোগ আবদুল হালিমের বিরুদ্ধে নতুন নয়। এ পর্যন্ত যতগুলো বিদ্যালয়ের তিনি শিক্ষকতা করেছেন, প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয় থেকেই তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। তবে সু-কৌশলে যখন যাকে প্রয়োজন তাকে ‘ম্যানেজ’ করে প্রতিটি ঘটনাই ধামাচাপা দিয়েছেন তিনি।
তবে আশার কথা হলো, এবার তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে এবং অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে কমিটি। তাই অভিভাবকদের আশা, শিক্ষকরূপী এই অপরাধী এবার তার কৃতকর্মের যথাযথ শাস্তি পাবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত ২৮ জুলাই স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর মা আবদুল হালিমের বিরুদ্ধে তার মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে পাথরঘাটার উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের পরেই গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।
অভিযোগের সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার (৬ সেপ্টেম্বর) পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়নের নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়ে গিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর। পঞ্চম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রী জানায়, সকালে স্কুলে কোচিং ও রাতে প্রাইভেট পড়ানোর সময় প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিম নানা অযুহাতে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশে হাত দেন। সেইসঙ্গে অশোভন কথাও বলেন। শুধু তাই নয়, এসব কথা কাউকে না বলতে হুমকিও দেন তিনি। প্রায় প্রতিদিনই কাউকে লাইব্রেরিতে ডেকে, সন্ধ্যার পর কোচিং করানোর সময়, সকালে প্রাইভেট পড়ানোর সময়, ব্ল্যাক বোর্ডে অংক করানোর সময়, এমনকি টিউবয়েলে পানি আনার সময়ও তিনি নানাভাবে তাদের হয়রানি করতেন।
স্কুলটির চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির অন্তত ২০ ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেল শিক্ষার্থীদের কাছে। ছাত্রীরা জানায়, এসব হয়রানির ঘটনা প্রকাশ না করতে আবদুল হালিম নিজে তো হুমকি দেনই, তার সঙ্গে আরও যোগ দেন শিক্ষক ডলি রাণী। এই শিক্ষক স্কুলে প্রধান শিক্ষকের ‘অনুগত’ হিসেবে পরিচিত। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে তিনি ছাত্রীদের ভয়ভীতি দেখান বলেও অভিযোগ করে ছাত্রীরা।
কয়েকজন অভিভাবক বলেন, ডলি রাণী প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে কিছু বিশেষ সুবিধা নেন, তিনি সময় মতো স্কুলে থাকেনও না। এসবের বিনিময়ে তিনি আবদুল হালিমের হয়ে ছাত্রীদের হুমকি দেন।
ঘটনা সত্যতা কিছুটা পাওয়া যায় বৃহস্পতিবারও। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ডলি রানীকে স্কুলে পাওয়া যায়নি। হাজিরা খাতায় দেখা যায় তিনি সকাল ৯টায় ঢুকেছেন ও বিকেল সাড়ে ৪টায় বের হয়ে গেছেন।যদিও তখন কেবল দুপুর সাড়ে ১২টা বাজে।আবার সেদিন যেহেতু বৃহস্পতিবার সেহেতু স্কুল ছুটির সময় আসলে দুপুর আড়াইটা।
এসব বিষয়ে জানতে ডলি রাণীকে টেলিফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘বাচ্চা অসুস্থ থাকায় আমি ছুটির আগেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে জানিয়ে চলে এসেছি।’ তবে কেন সাড়ে ৪টায় বের হওয়ার সময় লিখেছেন সেই প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।
আরেক অভিভাবক জানান, তার নাতনি একদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে। কী হয়েছে জানতে চাইলে সে জানায়, প্রধান শিক্ষক তার শরীরে অযাচিতভাবে হাত দিয়েছেন। পরে বিষয়টি তিনি নেসার নামে এক সহকারী শিক্ষককে জানান। পরেরদিন স্কুলে যাওয়ার পর আবদুল হালিম ওই ছাত্রীসহ কয়েকজনকে ডেকে আবারও ভয় দেখান ও স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন।
কয়েকজন অভিভাবকের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে সহকারী শিক্ষক নেসার বিষয়টি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে জানালে কৌশলে তাকেও বদলি করে দেওয়া হয় বলে জানান আরেক ছাত্রীর মা। টাকার বিনিময়ে বিষয়টি ম্যানেজ করার অভিযোগও করেন তিনি। এরপর থেকে মেয়েকে আর স্কুলে পাঠানটি বলেও জানান এই অভিভাবক।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বিদ্যালয়টির পিটিআই সভাপতি নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি জানার পর প্রধান শিক্ষক হালিমের সাথে কথা বলি। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তিনি আমার হাতে পায়ে ধরে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। পরে আমি বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে আলাপ করি।’
অন্যদিকে শুধু নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়েই নয়। আবদুল হালিম এর আগে যেসব স্কুলে ছিলেন সেখানেই তার বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এর আগে ৭০ নম্বর হরিদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাথরঘাটা মডেল, পাথরঘাটা আদর্শ, বাদুরতলা, টেংরা, গাববাড়িায় ও পূর্ব ঘুটাবাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীনও আবদুল হালিমের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল।
এছাড়া পূর্ব কালীবাড়ি হাসানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকাকালীনও আবদুল হালিমের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠায় তাকে বদলি করা হয়। সেখান থেকেই বর্তমান কর্মস্থলে যোগ দেন তিনি।
আবদুল হালিম যেসব স্কুলে এক আগে চাকরি করেছেন সেখানকার কয়েকজন প্রধান শিক্ষক ও তখনকার বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির (এসএমসি) সভাপতিরা সারাবাংলাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বর্তমানে নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি রিয়াজ উদ্দীনকে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির বিষয়গুলো জানানোর পরও তিনি ব্যবস্থা নেন। উল্টো টাকার বিনিময়ে তিনি বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে শনিবার (৭ আগস্ট) দুপুরে রিয়াজ টেলিফোনে সারাবাংলাকে বলেন, ‘অভিভাবকদের অভিযোগের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষ তদন্ত করছেন। তার (প্রধান শিক্ষক) বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা ধামাচাপার অভিযোগ সত্যি নয় বলেও দাবি করেন তিনি।
প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিম তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘নেসার উদ্দীন নামের একজন সহকারী শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের দিয়ে এসব মিথ্যে অভিযোগ করেছেন।’
তবে একাধিক ছাত্রী কেন একই অভিযোগ করছে, এমনকি আগের কর্মস্থলের বিদ্যালয়গুলোর ছাত্রীদেরও কেন এমন অভিযোগ ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে, আপনারা তাদের কাছে যান, তারা ভালো বলতে পারবেন।’
বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিও) মিজানুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পরপরই আমি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিই। তদন্তে হালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আমি (বিভাগীয় শিক্ষা কর্মকর্তা) স্যারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন ডিডি প্রেরণ করেছি।’