‘সফল রাষ্ট্রনায়ক’ এরশাদকে নিয়ে সংসদে শোক প্রস্তাব
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২১:৪১
সংসদ ভবন থেকে: স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদকে সফল রাষ্ট্রনায়ক ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক উল্লেখ করে জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) একাদশ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এইচ এম এরশাদের মৃত্যুতে উত্থাপিত শোক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শেষে রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদ অধিবেশন মুলতবি করা হয়।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে গৃহীত শোক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই সংসদ প্রস্তাব করছে যে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে দেশ একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সফল রাষ্ট্রনায়ক ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবককে হারালো। এ সংসদ তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও বিদেহী আত্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করছে। একইসঙ্গে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা প্রকাশ করছে।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলের উপনেতা রওশন এরশাদ ব্যক্তিজীবনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ কোনো ভুল-ত্রুটি করলে তার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
তিনি বলেন, অসম্ভব জনপ্রিয়, বিনয়ী ও জনদরদী নেতা ছিলেন এইচ এম এরশাদ। একজন স্ত্রী পক্ষে স্বামীর শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণ অত্যন্ত কষ্টের, বেদনার। দেশের মানুষকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন, সত্যিকারের পল্লিবন্ধু ছিলেন।
আলোচনায় আমির হোসেন আমু তার ১৭ সেকেন্ডের বক্তব্যে বলেন, দোষে-গুণে মানুষ। এ মুহূর্তে তাকে (এরশাদ) নিয়ে কোনো আলোচনা করতে চাই না। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, মানুষ মরণশীল। আমাদেরও একদিন চলে যেতে হবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকে মেজর থেকে বিগ্রেডিয়ার পর্যন্ত পদোন্নতি দিয়েছেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের সময় আমাদের মধ্যে মত-পথের পার্থক্য ছিল। আমরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি (এরশাদ) অত্যন্ত বিনয়ী ও নরম হৃদয়ের সজ্জন মানুষ ছিলেন।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এইচ এম এরশাদ অত্যন্ত মৃদুভাষী নেতা ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে নিজ জেলা রংপুরের প্রতি তার মমত্ববোধ দেখেছি। তিনি বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীনও দেখেছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষমতায় থাকতে খুনী জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এইচ এম এরশাদও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করেছেন, ঘৃনিত খুনী কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিলেন।
এরশাদকে ’অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা’ উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ২৭ বছর রাজনীতিতে ছিলেন এইচ এম এরশাদ। গণতন্ত্র রক্ষা ও বিকাশে তিনি কাজ করেছেন। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়েছেন। জীবদ্দশায় একটি সংসদ ছাড়া সব সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেছেন। তিনি ছিলেন জননন্দিত রাজনীতিবিদ। সব রাজনীতির সমীকরণে প্রধান নিয়ামকও ছিলেন। আসলে এইচ এম এরশাদ ছিলেন পল্লিবন্ধু।
বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, জন্ম হলেই মৃত্যু অনিবার্য। এইচ এম এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এইচ এম এরশাদ অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও তাকে (এরশাদ) নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলেন, এই সংসদেই দাঁড়িয়ে বিনয়ী সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেননি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হয়ে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধি জিয়ারত করেছেন।
এরশাদকে জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো হয়েছে— বিএনপির সংসদ সদস্যদের এমন অভিযোগ নাকচ করে রাঙ্গাঁ বলেন, তাকে কখনোই জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। গণতান্ত্রিক সরকারের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, দেশের মানুষের যেকোনো দুঃসময়ে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন এইচ এম এরশাদ প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সবসময় শ্রদ্ধা করতেন তিনি। প্রশাসনিক সংস্কার করে উপজেলা পরিষদ করেছিলেন, জেলা বাড়িয়েছেন। দেশের মানুষ সস্তায় ওষুধ কিনে খাচ্ছেন— তা এরশাদের প্রণীত ওষুধ নীতির কারণেই।
তরিকত ফেডারেশনের মুজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, দোষে-গুণেই মানুষ। সবারই ভুল হয়। বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতার সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে সংবিধান রক্ষায় পরবর্তী সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এরশাদ।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় আরও অংশ নেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু, মো. ফখরুল ইমাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, আহসান আদিলুর রহমান, পীর ফজলুর রহমান, সালমা ইসলাম ও নাজমা আখতার। আলোচনা শেষে সর্বসম্মতক্রমে শোক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।