হালিমা ও আল আমিনদের জীবন বদলে গেছে যেভাবে
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৯:৫৮
ঢাকা: পাঁচ ভাই-বোনের সংসারে দারিদ্রতার অভিশাপ সঙ্গে নিয়ে জন্মেছিলেন হালিমা। অভাব ঘোঁচাতে দু’হাত পেতে ভিক্ষা করবেন সেই সুযোগও ছিল না, কারণ জন্মের সময় থেকে তার একটি হাতই নেই। সেই না থাকা নিয়েই একা একা লড়েছেন। পড়ালেখা করেছেন। নিয়েছেন গার্মেন্টস ফিনিশিং এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ওপর প্রশিক্ষণ। এরপর তাকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন বাবা-মায়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছেন তিনি নিজেও।
গাজীপুরের আল আমিনের গল্পটাও খুব কাছাকাছি। জন্মের আগেই তিনি বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর মায়ের সঙ্গে দারিদ্র্যতার হাতে হাত রেখে পার করেছেন শৈশব ও কৈশোর। মা কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। খাবার জোগাতে কাজ করতে হতো আল আমিনকেও। ফলে আল আমিনকে নিয়ে তার মা যে স্বপ্ন দেখতেন সেটাকে এক রকম কবর দিতে হয়েছিল। তবে হঠাৎই বদলে যায় পরিস্থিতি।
আল আমিন এবং হালিমার জীবন বদলের চেষ্টায় পাশে ছিল একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইউসেপ। পড়ালেখা করা এবং কর্মমুখী বিষয়ে নানা প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এই সংস্থাটি।
ইউসেপ বা আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস এডুকেশনাল প্রোগ্রামস বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এনজিও। মূলত দরিদ্র ও কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে এই সংস্থাটি।
ইউসেপ’র শুরু
প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। সে সময় সহযোগিতা করতে আসেন লিন্ডসে অ্যালেন চেইনী নামে একজন উন্নয়নকর্মী। নিউজিল্যান্ডের এই সেবাকর্মী দেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলীয় এলাকার মা ও শিশুদের সেবা দিতেন। পরে তার আহ্বানে ডেনমার্ক সরকার আর্থিক সহায়তাসহ ১৯৭২ সালে ইউসেপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করায়।
শুরুর দিকে ইউসেপ কমিউনিটি স্কুলের মডেল অনুযায়ী দরিদ্র ও কর্মজীবী শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। শিশুদের জন্য ইউসেপের শিক্ষা মডেল সে সময় সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ১৯৮৩ সালে সাধারণ শিক্ষাদান কর্মসূচির সঙ্গে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চালু করে ইউসেপ। ধীরে ধীরে এর কার্যক্রম ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম এবং খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৯০ সালে এটি জাতীয় এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত হয়।
প্রায় দুই দশক ধরে ইউসেপের সঙ্গে কাজ করছেন আনোয়ারুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত।
ইউসেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন পিছিয়ে পড়া শিশু বা কিশোরকে বাইরের পৃথিবীর জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয় ইউসেপ। গার্মেন্টস, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানসহ অনেকগুলো চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। প্রশিক্ষণ শেষে সেসব জায়গায় তাদের আমরা কাজ করার সুযোগ করে দেই। একজন মানুষের ভবিষ্যত যতটা সুন্দর করে গড়ে দেওয়া যায়— সেই চেষ্টাই করি আমরা। তাই ইউসেপকে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য একটি আশ্রয়দাতা প্রতিষ্ঠানও বলা যায়।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট এবং গাজীপুর জেলায় ৩২টি সাধারণ বিদ্যালয় এবং একটি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে ইউসেপ। রয়েছে দশটি কারিগরি বিদ্যালয়ও। ঢাকা ও সিলেটে দু’টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ শিক্ষার্থীদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১০টি অঞ্চলে এক হাজার শিল্পপতিদের সঙ্গে ১৭টি কর্মী কমিটিও করে রেখেছে ইউসেপ। ২০০৩ সালের পর কিছুদিন দেশের বাইরেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে ইউসেপ।
২০০৪ সাল থেকে ‘লেট চিল্ড্রেন স্পিক’ নামে শিশু অধিকার বিষয়ে একটি অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম চালু করে ইউসেপ। এই প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য সব শিশুকে স্কুলমুখী করা ও সব ধরনের শিশু নির্যাতন বন্ধে শিশুদের এবং অভিভাবকদের সচেতন করা। ২৪টি পার্টনার এনজিওর মাধ্যমে ১০টি জেলায় এ প্রোগ্রাম পরিচালিত হয়। ২০০৫ সাল থেকে ইউসেপ শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ প্রকল্প শুরু করে যার মাধ্যমে ইউসেপ থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করে এরা নিজেরাই ব্যবসা করে স্বনির্ভর হতে পারে।
ইউসেপ অবশ্য এখন বেশ বড়ো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কেবল ২০১৮ সালেই তারা ৪ লাখ ১৪ হাজার ৯৯৭ জনকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৭২ প্রাথমিকে, সাড়ে চার হাজারের বেশি জেএসসিতে, এসএসসিতে ৩২৬ জন ইউসেপের স্কুল থেকে পাস করেছে। এছাড়া ১৩ হাজারের কিছু বেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট এবং ১০ হাজার ৯২১ জনকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইউসেপের রিজিওনাল ম্যানেজার আশরাফ উদ্দিন বলেন, আমরা ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের সাধারণ শিক্ষা দিয়ে থাকি। দুই একটি ক্ষেত্র বাদে ১৬’র বেশি বয়সীদের চাকরির উপযোগী প্রশিক্ষণ দেই। আমাদের এখানে যারা শিখছে তারা হয়তো পিছিয়ে থেকে শুরু করে, তবে শুরু করার পর আর পিছিয়ে থাকতে হয় না। আমরা তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তুলি। এমনকি এখান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর যখন তারা চাকরিতে প্রবেশ করে এরপরও তাদের ওয়ার্কপ্লেস এনভায়ারনমেন্ট নিয়ে আমরা কাজ করি।
ইউসেপ’র সাধারণ বিদ্যালয়গুলোকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই অনুসরণ করা হয়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ের সঙ্গে ইউসেপ’র নিজস্ব বইও পড়ানো হয়। এভাবে পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা, জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে ইউসেপ দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করছে।
ইউসেপ’র প্রশিক্ষণ কোর্স
কারিগরি স্কুলগুলোতে ইউসেপ ৩ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যে মৌলিক কারিগরি শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলে। ইউসেপ’র ৩৭টি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কোর্সের মধ্যে রয়েছে— অটো মেকানিক্স, ওয়েলডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন, মেশিনিস্ট, প্লাম্বিং অ্যান্ড পাইপ ফিটিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল, ইলেকট্রনিক টেকনোলজি, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং, ইন্ডাসট্রিয়াল উড ওয়ার্কিং, টেইলরিং অ্যান্ড ইন্ডাসট্রিয়াল সিউইং অপারেশন, ইন্ডাসট্রিয়াল উল নিটিং অপারেশন, গার্মেন্টস ফিনিসিং অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল, ইন্ডাসট্রিয়াল গার্মেন্টস মেশিন মেকানিক্স, টেক্সটাইল ওয়েভিং মেকানিক্স, টেক্সটাইল স্পিনিং মেকানিক্স এবং টেক্সটাইল নিটিং মেকানিক্স।
এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ইউসেপ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। এসব বিদেশি সংস্থার মধ্যে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারনেশনাল ডেভলপমেন্ট, ইউকে এইড, ডিপার্টমেন্ট অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্স এন্ড ট্রেড অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক নামজাদা চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইউসেপের তহবিলের অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে ইউসেপ’র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্য, স্টুডেন্ট স্পন্সরশিপ, সেবামূলক অনুদান এবং সরকার, সিটি করপোরেশন এবং ব্যক্তি কর্তৃক দানকৃত জমি।