মেয়রের জন্য নগর ভবনে র্যাম্প, প্রতিবন্ধীদের জন্য বসবে কবে?
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৪২
ঢাকা: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নগর ভবনে সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে র্যাম্প (ভবনে ওঠা-নামার ঢালু সিঁড়ি)। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম সম্প্রতি পায়ে আঘাত পেয়ে হুইল চেয়ারে করে চলাচল করছেন বলে তার সুবিধায় এই র্যাম্প বসানো হয়েছে। অথচ বিভিন্ন সরকারি ভবন ও স্থাপনায় প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের সুবিধায় র্যাম্প বসানো নিয়ে সুস্পষ্ট আইন থাকলেও তা এতদিনেও বাস্তবায়ন হয়নি খোদ ডিএনসিসি নগর ভবনেও।
প্রতিবন্ধীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়র পায়ে আঘাত পাওয়ার পর তার জন্য র্যাম্প বসানো হয়েছে নগর ভবনে। কিন্তু গণস্থাপনাগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য র্যাম্প বসানো হবে কবে? মেয়র আতিকুল ইসলাম অবশ্য বলছেন, প্রতিবন্ধীদের চলাচলে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো যত দ্রুতসম্ভব দূর করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর মহাখালীতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বংশবিস্তার প্রতিরোধে বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনে অভিযানে যান ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এসময় পারটেক্স গ্রুপের একটি নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা পাওয়া যায়। ওই ভবনে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালিতে আঘাত পান মেয়র আতিকুল। ওই সময় তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পা মচকে যাওয়ায় চিকিৎসকরা সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন। কিন্তু আমি তো বসে থাকতে পারি না। তাই হুইল চেয়ারে বসেই কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’ সম্প্রতি ডিএনসিসি নগর ভবনে তার যাতায়াতকে ‘প্রবেশগম্য’ করতেই এই র্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, নগরে ভবনে র্যাম্প বসানো হয়েছে, এটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আনন্দের খবর। কিন্তু এই র্যাম্প তো প্রতিবন্ধীদের অধিকার। অনেক আগেই এই র্যাম্প বসানো উচিত ছিল। তারপরও নগরপিতা যখন র্যাম্পের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তাদের প্রত্যাশা— সব ভবনেই এমন র্যাম্পসহ অন্যান্য সুবিধা স্থাপনের উদ্যোগ নেবেন তিনি।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর ২ (১৩) ধারায় ভৌত অবকাঠামো, যানবাহন, যোগাযোগ, তথ্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ জনসাধারণের জন্য প্রাপ্য সব সুবিধা ও সেবায় অন্যদের মতো প্রতিটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমসুযোগ ও সমআচরণ প্রাপ্তিকে ‘প্রবেশগম্যতা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
একই আইনের ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, সাধারনের যাতায়াত রয়েছে, এমন বিদ্যমান সব গণস্থাপনা যত দ্রুত ও যতদূর সম্ভব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরোহন, চলাচল ও ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। আইনে ‘গণস্থাপনা’ বলতে সর্বসাধারণ চলাচল করে— এমন সব সরকারি ও বেসরকারি ইমারত বা ভবন, পার্ক, স্টেশন, বন্দর, টার্মিনাল ও সড়ককে নির্দেশ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন প্রতিবন্ধী রিফাত পাশা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, মেয়র নিজে অসুস্থ হওয়ার পর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কষ্টটা অনুভব করেছেন। এটি একদিকে আমাদের জন্য আনন্দের, আবার কষ্টেরও। কারণ আমরা কেউ চাই না যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কেউ কিছু করতে হলে তাকেও প্রতিবন্ধী হতে হবে। এটা মানবিক নয়। আমরা চাই, আমাদের জন্য যেসব অধিকার রয়েছে, সেগুলো যেন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যখন দেখি একজন মেয়র অসুস্থ হওয়ার পর তার জন্য ভবনে র্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে, তখন আমাদেরও জানতে ইচ্ছে হয়, আমাদের জন্য র্যাম্প বসানোর উদ্যোগ কি তিনি নেবেন?
প্রতিবন্ধীদের ক্রীড়া সংগঠন বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড (পিসিএপিসি)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, মেয়র অসুস্থ হওয়ায় যেহেতু প্রতিবন্ধীদের কষ্ট অনুভব করেছেন, এখন নিশ্চয় তিনি তাদের জন্য ভালো কিছু করবেন। প্রত্যাশা করছি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যেসব সমস্যা ও সংকট রয়েছে নগরীতে, সেসব সমস্যার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সেগুলো সমাধানের দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেবেন মেয়র।
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যাডভাইজর সাইফুল আলম সৌভন সারাবাংলাকে বলেন, ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগই প্রতিবন্ধকতার শিকার। সে অনুযায়ী রাজধানীতে যদি এক কোটি মানুষের বসবাস ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তাদের অন্তত ১৫ লাখ প্রতিবন্ধী। এই বিপুলসংখ্যক মানুষেরও সব ধরনের গণস্থাপনায় নিরাপদে যাতায়াতের অধিকার রয়েছে আইনেই। কিন্তু সেই আইনের বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি।
তিনি বলেন, মেয়র অসুস্থ হওয়ার পর সিটি করপোরেশনে র্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে জেনে খুশি হয়েছি। আমরা চাই এই র্যাম্প যেন স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়। আর শুধু নগর ভবন নয়, মেয়র তার পুরো এলাকাতেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলাচলবান্ধব পরিবেশ তৈরি করবেন— এটুকু আমরা আশা করছি।
সাইফুল আরও বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থানসহ গণস্থাপনাগুলোতে প্রবেশগম্যতার বিষয়টি এখনও উপেক্ষিত। বর্তমানে সিটি করপোরেশনের পার্ক, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব কোনো অবকাঠামো নেই। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে মেয়রকে এবার তৎপর হতে হবে।
‘সিটি করপোরেশনসহ অনেক সেবা সংস্থার ভবনেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নেই। এর মাধ্যমে এসব সংস্থা কেবল প্রতিবন্ধীদের অধিকার বঞ্চিতই করছে না, তারা দায়িত্বে অবহেলা করছে এবং সুনির্দিষ্টভাবে আইনও লঙ্ঘন করছে। দেশে যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও থাকেন, সে বিষয়টিই যেন অস্বীকার করছে তারা,’— বলেন সাইফুল আলম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আমি অসুস্থ হওয়ার আগেই র্যাম্পসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের নির্দেশনা ছিল। তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছিল ধীরে। ডিএনসিসির অধীন সব ভবনসহ যেসব স্থানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো সমাধান করতে এবার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এই নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।
২০১৩ ডিএনসিসি ডিএনসিসি মেয়র নগর ভবন প্রতিবন্ধী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন মেয়র আতিকুল ইসলাম র্যাম্প