আগলে রাখা সব নথি দলের আর্কাইভে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২৩:০৪
ঢাকা: তিল তিল করে আগলে রাখা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন নথিপত্র তথা দলীয় সম্পদগুলো দলের কাছে হস্তান্তর করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে দলের হাল বয়ে চলা চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগে দলীয় নথিপত্রগুলো শ্রেণিকরণ করে আর্কাইভ করার জন্য দলের কাছে হস্তান্তর করবেন বলে মনস্থির করেছেন।
শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ বিষয়টি উত্থাপন করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গণভবনে দলের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপ দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার সঙ্গে বৈঠক করে নিজের একান্ত ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন।
সেদিন আওয়ামী লীগ সভাপতি ঘরোয়া এ বৈঠকে বলেন, ‘আমি তিল তিল করে এতদিন দলীয় এই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের নথিগুলো সংগ্রহ করে রেখেছি। কয়েকটি ট্রাঙ্কে নথিগুলো গচ্ছিত রেখেছি। এগুলো দলীয় সম্পদ। তাই দলের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আমি চাই, আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে এ নথিগুলো শ্রেণিকরণ করে আর্কাইভ করে রাখুক। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।’
এরপর ওই বৈঠকের সূত্রে পরবর্তীতে দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনা অনুসারে ধানমন্ডি-৩/এ তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সভাপতির সংগ্রহে থাকা গচ্ছিত কিছু নথিপত্র গণভবনে দলীয় সভাপতির কাছে হস্তান্তর করেন।
প্রসঙ্গত, এই আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে সংগৃহীত নথিপত্রের মধ্যে বিশেষ করে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দলের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করার সময়কালে তৃণমূলের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, পৌরসভা কমিটি, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীর তালিকা, বিভিন্ন দলীয় সার্কুলার, প্রেস বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন সাংগঠনিক দলিল দস্তাবেজ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি তিলতিল করে এগুলো সংগ্রহ করে দুইটি বড় আকারের ট্রাঙ্কে সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। এছাড়াও তার সঙ্গে ১৯৮১ সালের পূর্বের কিছু নথিপত্র সংগ্রহে আছে বলেও অবহিত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এদিকে শনিবার বৈঠকে জাতীয় সম্মেলনসহ সাংগঠনিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্বান্ত গ্রহণ করতে বৈঠকে বসছে ক্ষমতাসীন দলটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপদফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ফোন রিসিভ করেনি।
এরইমধ্যে চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রেকর্ড গড়েছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ওই বছরের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিজয়ের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট আবারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে একই বছরের ১২ জানুয়ারি টানা দ্বিতীয় ও মোট তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিপুল বিজয়ের সোমবার চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা।
১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ৩টি সংসদীয় আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ নির্বাচনের পরেই দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। শেখ হাসিনা ৯০ এর ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব তেন এবং আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়।
১৯৯১ সালের সংসদীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ সকলকে সংগঠিত করেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি’র ভোটারবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে তিনি গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়।
২০০৯ সালে সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে তার সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এ আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৫ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি এই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন।
শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই শেখ হাসিনা সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ৬ বছর ভারতে অবস্থান করেন।
১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয়বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনা শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। তাকে বারবার কারাগারে রাখা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়।
১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাকে আটক করে ১৫ দিন কারাগারে রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাকে দুবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২ মার্চ তাকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করে এক মাস কারাগারে রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাব জেলে পাঠায়। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাকেসহ তার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাকে লক্ষ্য করে দুইবার গুলি করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার হামলা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তার কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়। শেখ হাসিনা পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো শনাক্ত হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোড়া হয়। লোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তার দলের ২২ নেতাকর্মী নিহত হন এবং পাঁচশ’র বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।
শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে আর্থ-সামাজিক খাতে দেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।