শ্যালক ছাড়া কাজ হয় না জয়পুরহাটের সরকারি টিটিসি’তে!
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১১:০৯
জয়পুরহাট: অধ্যক্ষের শ্যালকের মাধ্যমে তদবির না করলে জেলার সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) কোনো কাজ হয় না বলে অধ্যক্ষ প্রকৌশলী দেলোয়ার উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগে উঠেছে। এছাড়াও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়মসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে জানিয়েছেন অভিযুক্ত দেলোয়ার উদ্দিন।
জানা যায়, সরকারি অনুদানে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে জয়পুরহাট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইলেকট্রিক্যাল, কম্পিউটার, গার্মেন্টস্, ইলেকট্রনিক্স, অটোমেটিভ ও অটোক্যাড— এই ৬টি ট্রেড নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করে। এই ট্রেডগুলোর মধ্যে একজন রাজস্ব খাতের প্রশিক্ষক ছাড়া অবশিষ্টগুলোতে খণ্ডকালীন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন প্রকৌশলী দেলোয়ার উদ্দিন আহমেদ। অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তিনি জয়পুরহাট টিটিসিকে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
সরেজমিনে জানা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার পরও অধ্যক্ষ তার শ্যালক ওয়াসিম মিয়াকে ৩য় ব্যাচের (মে-আগস্ট) সেইপ কোর্সের প্রশিক্ষণার্থী (রেজি: ২২০০০৭৬৬০৬) হিসেবে ভর্তি করান। যা নিয়ম বর্হিভূত। পরে বিআরটিএ’র ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদপত্র না থাকার পরও তাকে সান্ধ্যকালীন মোটর ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণার্থীদের সারা বছরের খাবার দেওয়াসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন অধ্যক্ষের শ্যালক ওয়াসিম। এছাড়া শ্যালকের মাধ্যমে তদরির না করলে এখন কোনো কাজই হয় না এই টিটিসিতে।
প্রশিক্ষণার্থীরা জানান, রেজুলেশন ছাড়াই অধ্যক্ষ তার শ্যালককে দিয়ে ১০০ টাকা করে প্রায় ২৮৭টি ফরম বিতরণ করেছেন। এখানে মৌখিক পরীক্ষায় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিরিটি ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। এছাড়া অধ্যক্ষ নিজেই রেজাল্ট তৈরি করে ফেসবুক এবং অফিসের দেওয়ালে লাগিয়ে দেন। এভাবে ২০১৯ সেশনের দু’টি শিফটে ৫ম ও ৬ষ্ঠ ব্যাচে মোট ৪০ জন এবং ২০২০ সেশনের জানুয়ারি-এপ্রিলের দু’টি শিফটে ৪০ জনকে ৭ম ও ৮ম ব্যাচের জন্য অগ্রিম ভর্তির রেজাল্ট দিয়েছেন।
জয়পুরহাট সদরের হিচমী পশ্চিমপাড়ার আরিফুল ইসলাম, আব্দুর মোমিন, আল-আমিনসহ একাধিক পরীক্ষার্থী জানান, ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে তিন বার পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু সুপারিশের লোক না থাকায় আমরা ভর্তির সুযোগ পাইনি।
এদিকে টিটিসির প্রশিক্ষণার্থী আব্দুর রাহিম, শাহ জলিল, রাসেল বলেন, ‘আমাদের শুধু থিওরি ক্লাস ও ক্যাম্পাসের ২০০ গজ জায়গায় ড্রাইভিং স্টেয়ারিং ধরা শেখানো হয়েছে। বাইরে নিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং শেখানোর কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা করে না।’
নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক একাধিক নারী প্রশিক্ষণার্থী অভিযোগ করে জানান, সরকারিভাবে খাবারের জন্য প্রতি প্রশিক্ষণার্থীর জন্য ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও টিটিসি ক্যাম্পাসের মধ্যে লাগানো পেঁপে ও কলার তরকারিসহ নিম্নমানের খাবার এখানে দেওয়া হয়। এই খাবারের দায়িত্বে থাকেন অধ্যক্ষের শ্যালক ও শ্যালকের স্ত্রী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জয়পুরহাট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের চাকরিরত কয়েকজন কর্মচারী বলেন, ‘এই অধ্যক্ষ আসার পর কর্মচারীদের ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে। এমনকি আমাদের বেতনের টাকা থেকেও তাকে সন্তুষ্ট করতে হয়। খণ্ডকালীন প্রশিক্ষক হওয়ায় আমরা কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না।’
তবে অধ্যক্ষের দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলেছেন ইন্সট্রাক্টর (রাজস্ব) জিএস সুলতান আল-আমিন। তিনি জানান, আগের অধ্যক্ষের কাছ থেকে লিখিতভাবে দায়িত্ব বুঝে না নেওয়ার সুযোগ নিয়ে বর্তমান অধ্যক্ষ অর্থ আত্মসাৎ করছেন। দীর্ঘ ৮ মাস ধরে তিনি নিজের ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া অধ্যক্ষ ৪০ দিন আগে প্রশিক্ষণার্থীদের বৃত্তির ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে নিজের পকেটে রেখেছেন।
‘অধ্যক্ষের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় আমাকে বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকি দেওয়া ছাড়াও আমাকে বিভিন্নভাবে লাঞ্চিত করা হয়। এ ব্যাপারে আমি জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক এর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি’, বলেন এই কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ দেলোয়ার উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘শ্যালক ওয়াসিমকে নিয়ম মেনেই ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং সে ২ মাস মেয়াদী খণ্ডকালীন প্রশিক্ষককেরও দায়িত্ব পালন করবে। আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘এই কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসির) অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জেনেছি। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম জানান, টিটিসি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।