দুদকের কাছে বেনামি অভিযোগে কাস্টম কর্মকর্তাকে হয়রানি
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:০৩
ঢাকা: কাস্টম কমিশনার বেলাল চৌধুরীর নামে একটি বেনামি অভিযোগ সামলাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে বেনাপোল কাস্টম হাউস। তার নামে ৪টি অভিযোগের মধ্যে দুদক সদর দফতর ২টি, দুদকের যশোর বিভাগীয় অফিস ও আরেকটি দুদকের অনুরোধে এনবিআর থেকে ১টি অনুসন্ধান চালানো হয়। দুদকের যশোর বিভাগীয় অফিস ও এনবিআরের তদন্তে এরইমধ্যে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন বেলাল চৌধুরী।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের এক কমর্কতা সারাবাংলাকে বলেন, প্রধান কার্যালয় থেকে এখনো তদন্ত শুরু হয়নি। তদন্ত যেহেতু শুরু হয়নি তাই এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, দুদকের হবু ডিজি পরিচয়ে আহসান আলী নামে এক ব্যক্তি বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় ভুয়া অভিযোগ জমা দেন।
সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের নির্দেশে ৪ জায়গা থেকে তদন্ত করা হচ্ছে বিষয়টি। চারটি তদন্তের মধ্যে ২টি দুদক সদর দফতর, ১টি দুদকের যশোর বিভাগীয় অফিস ও আরেকটি দুদকের অনুরোধে এনবিআর থেকে। সবমিলিয়ে প্রায় ৯ মাসের দুদকের যশোর বিভাগীয় অফিসসহ তিন শাখা ও এনবিআরের তদন্তে বেলাল চৌধুরী নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন।
আরও জানা গেছে, এনবিআরের তদন্তে ১৫টি অভিযোগের একটিও প্রমাণ না হওয়ায় কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দুদক কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে ভুয়া ডিজি পরিচয়দাতা আহসান আলী বেনাপোলে গিয়ে কমিশনারকে অবৈধ তদবীর ও চাপ দেওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে ২০ লাখ টাকা শুল্ক কম দেওয়ার জন্য তিনি কমিশনারকে চাপ দিচ্ছেন বলেও দেখা গেছে।
শুধু তাই নয়, এর আগে দুদকের অনুরোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক: নীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে বেনামি অভিযোগের তদন্ত করেন। এনবিআরের প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে করা ২৪টি অভিযোগ ভুয়া প্রমাণিত হয়। অভিযোগে তার নামে যেসব বাড়ি ও ফ্ল্যাটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শ্বশুর-শাশুড়ির ধানমণ্ডির বাড়িও আছে।
জানা গেছে, এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আহসান আলী নাম বদলে সাহাদাত হোসেন নামে বেনামি অভিযোগ করেছে। ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাসার ঠিকানায় ধানমণ্ডির যে হোল্ডিং নম্বর ব্যবহার করেছেন সেটিও তার নয়। যেসব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ করা হয়েছে, তদন্তে সেসব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের নাম-ঠিকানারও সত্যতা মেলেনি। এছাড়া, বেনামি অভিযোগে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে ৪৮০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির কথা বলা হলেও এ বিষয়ে তদন্তে সুনির্দিষ্ট বিল অব এন্ট্রি সংক্রান্ত কোনো তথ্য মেলেনি। অভিযোগে শেখ মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীর মালিকানা হিসেবে মেসার্স ট্রিনা অ্যাসোসিয়েশনের কথা বলা হলেও বাস্তবে ওই ব্যক্তি কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নন।
এনবিআরের তদন্তে দেখা যায়, বেনামি অবৈধ সম্পদের অভিযোগে বেলাল চৌধুরীর নামে ধানমণ্ডির ১৫/এ, রোড নম্বর-৪-এর ১৫ নম্বর বাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্তকালে দেখা যায়, ওই বাড়ির মালিক ও বসবাসকারী মো. আতিকুল করিম ও পাপ্পু। ওই বাড়িতে একটি ডেভেলপার কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া অভিযোগে ধানমণ্ডির ৫ নম্বর রোডের ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ নম্বর বাড়িটি বেলাল চৌধুরীর নামে উল্লেখ করা হয়। তদন্তকালে ওই বাড়ির মালিকানা হিসেবে স্থানীয় তিন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন- উজির আফজাল, নাজির আফজাল ও তৈয়ব আফজাল।
ধানমণ্ডির ৫ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর বাড়িটিও বেলাল চৌধুরীর নামে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। তদন্তকালে দেখা যায়, ওই বাড়িটি সাবেক নৌবাহিনীর প্রধান ও তারেক রহমানের শ্বশুর মরহুম মাহবুব আলী খানের নামে। বাড়িটির বর্তমান মালিক সৈয়দ ইকবাল মান্দ বানু। তার দুই মেয়ে জোবায়দা রহমান ও বিন্দু। অভিযোগে বসুন্ধরা জি-ব্লকে ১০ কাঠা জমির ওপর ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের ৬ তলা বাড়ির কথা বলা হলেও ওই তথ্যেরও সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটি।
বেনামি অভিযোগে বেলাল চৌধুরীর নামে যশোর এসপি অফিসের পাশে ১৫ কাঠা জমির ওপর ১৫ তলা ভবন নির্মাণ, ২ কোটি টাকা দিয়ে সিভিল সার্জন অফিসের পাশে ৩৩ শতাংশ জমি ক্রয় করে ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে ১০ তলা ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়। কিন্তু তদন্তে এর কোনো সত্যতাই মেলেনি। অভিযোগে নোয়াখালী শহরে ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে ১০ কাঠা জমির ওপর ৬ তলা বাড়ি নির্মাণের যে কথা বলা হয়েছে, তারও সত্যতা মেলেনি। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৫ নিউ ইস্কাটনে যে ফ্ল্যাটে বেলাল চৌধুরী পরিবার নিয়ে বসবাস করেন সেই ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। সেটিও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৮ বছরের ঋণ নিয়ে ২০১২ সালে ক্রয় করা। এগারো বছরের কিস্তি এখনো অপরিশোধিত।
উক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরেক বেনামি অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল হাসান গাজী তদন্ত করছেন।
দুদক এর আগে বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীসহ ৪টি বেনামি অভিযোগ তদন্ত করে। ২০০৯ সালে দুদক সদর দফতর থেকে সম্পদ বিবরনী দেড়বছর ধরে চুলচেরা তদন্ত করে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। ২০১২ সালে অবৈধ সুযোগ সুবিধা দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ ও শতকোটি টাকার রাজস্ব লোপাটের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় দুদক।
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আড়াই টন ভায়াগ্রা জব্দের আগে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। ৩১টি চালানে শুল্ক ফাঁকির আবদার না রাখায় আহসান আলী গত ডিসেম্বরে দুদকে বেনামি অভিযোগ জমা দেয়। ভায়াগ্রা গ্রুপের সঙ্গে মিলে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আমার পিছনে লাগে। আমি পৌনে দু’বছর ধরে কাজ করছি। দুইশ’র বেশি সংস্কার করেছি। বাণিজ্য ও যাত্রী সেবার মানোন্নয়নে এসব কাজ করেছি। ফলে, পণ্য আমদানি চালান ৩৩ দিনের জায়গায় ১ দিনে খালাস হচ্ছে। একজন যাত্রী ২/৩ ঘণ্টার জায়গায় ৫ থেকে ১৫ মিনিটে নির্বিঘ্নে ভারতে যাচ্ছে। আমি দুর্নীতি করি না, প্রশ্রয়ও দেই না। গত পৌনে দু বছরে আমার কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি নেতিবাচক সংবাদও প্রকাশ হয়নি। ২৪ জুলাই ভায়াগ্রা আটকের পর আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়। আমি ও আমার সহকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার কোটি টাকা মূল্যের ভায়াগ্রা জব্দ করেছি।
বিসিএস আয়কর এসোসিয়েশনের মহাসচিব নুরুজ্জামান খান এ বিষয়ে বলেন, সেগুন বাগিচা থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব কতো? একজন কমিশনারের বিরুদ্ধে তদন্ত চালুর আগে আরেকটু দেখে শুনে শুরু করা উচিত ছিল। আর যা হয়েছে সেটা কখনো কাম্য নয়।
বিসিএস কাস্টমস ও ভ্যাট এসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, বেনামি অভিযোগ আমলে নিলে এমন হয়। আমরা যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে। দুদকের অনেকেই জানে, এ কাজ আহসান আলী হয়রানি করার জন্য করা করেছে। দুদকের কিছু কর্মকর্তা তাকে আশ্রয় দিয়েছে। বেনাপোলের কমিশনারের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগের একটাও প্রমাণ হয়নি। এর নেতিবাচক প্রভাব যেমন রাজস্ব আদায়ের ওপর পড়েছে তেমনি কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।