যাত্রী ঝোলে বিআরটিসি বাসে, শ্রমিকের বেতন বকেয়া মাসের পর মাস
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:৫০
ঢাকা: রাজধানীর সড়কগুলোতে সড়ক পরিবহন করপোরেশন বিআরটিসি বাসে যাত্রীদের যেভাবে ঝুলতে দেখা যায়, তাতে নিঃসন্দেহে ভাবাই যায় কোম্পানির আয় ভালো। ওদিকে ঢাকার একটি ডিপো বাদে দেশের ২০টি বিআরটিসি ডিপোর শ্রমিকদের বেতন বকেয়া ছয় থেকে এক বছর পর্যন্ত! এমনকি ভারত থেকে নতুন বাস আসার পরও শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়ে আছে। তাহলে কোথায় যাচ্ছে বিআরটিসির আয়ের টাকা?
সারাবাংলা অনুসন্ধানে নামে বিআরটিসির জোয়ার সাহারা ডিপো ঘিরে। এ বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন এই ডিপোর শ্রমিকরা। তখন তাদের আট মাসের বেতন বকেয়া ছিল। ডিপো তালা দিয়ে চলমান আন্দোলনের এক পর্যায়ে সেখানে আসেন করপোরেশন চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া। তাকে ‘ভুয়া’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পরে ঘটনাস্থলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি মোশতাক আহমেদ ও র্যাব কর্মকর্তারা পৌঁছে পরিস্থিতি শান্ত করেন। তারা আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও ডিপোর কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠক থেকে বেতন পরিশোধের আশ্বাস পাওয়ায় শ্রমিকরা আন্দোলন তুলে নেন।
প্রথম পর্ব: ভারত থেকে আনা বিআরটিসি বাসে হাত দিলেই বডি বেঁকে যায়!
ওই সময় শ্রমিকদের আশ্বাস দেওয়া হয়, প্রতি মাসের সঙ্গে আগের বকেয়া একমাসের বেতন দেওয়া হবে। আর ডিপোতে নতুন বাস যুক্ত হওয়া সাপেক্ষে প্রতি মাসে দুই মাসের (এক মাসের বকেয়াসহ) বেতন দেওয়া হবে। প্রধান কার্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের চিঠিও পাওয়া গেছে সারাবাংলার অনুসন্ধানে। কিন্তু শ্রমিকদের দেওয়া সেই আশ্বাসকে আলোর মুখ দেখাতে পারেননি ওিই সময় বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া।
জানা যায়, নতুন বাস এসেও আগের মতো বকেয়া বাড়তে থাকে শ্রমিকদের। আরও দু’মাস বকেয়া বেড়ে ১০ মাস বেতনহীন হয়ে পড়েন জোয়ার সাহারা ডিপোর শ্রমিকরা। এ পরিস্থিতিতে ফের চেয়ারম্যানের অপসারণ চেয়ে বেতনের দাবিতে আন্দোলনে নামে শ্রমিকরা। শেষ পর্যন্ত গত ২ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়ার বিদায়ের দিনও শ্রমিকরা একই দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন।
নতুন বাস আসার পরও শ্রমিকরা কেন বেতন পাচ্ছেন না— এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে দেখা যায়, ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জোয়ার সাহার ডিপো ম্যানেজার ছিলেন নুরে আলম। তার সময়ে মতিঝিল আব্দুল্লাপুর রুটে ১৩টি এসি বাস চলত, টঙ্গী-মতিঝিল রুটে দ্বিতল বাস চলত ২০টি, বিশ্বরোড কড়িল রুটে চলত পাঁচটি এসি বাস, ননএসি ২২টি। এর বাইরে শহিদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য দেওয়া হয় চারটি বাস। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে জোয়ার সাহার ডিপোতে সচল বাস ছিল ৬৪টি। এর মধ্যে অবশ্য রমিজ উদ্দিনের চারটি বাসে মাসে ৪ লাখ টাকা ভর্তুকি দিত ডিপো।
ওই সাত মাসে এই ডিপোতে বেতন-ভাতা পরিশোধ হয় ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতি মাসেই নিয়মিত বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত যে বকেয়া ছিল, তাও পরিশোধ করা হয়েছে।
কিন্তু এ বছরের মার্চ মাসে এই ডিপোতে নতুন ১০টি এসি ও ২০টি ডাবল ডেকার বাস বরাদ্দ দেওয়া হয়। শ্রমিকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, প্রতিমাসে চলতি মাসের বেতন ও বকেয়া এক মাসের বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে না। আগের মতো একমাস করে বেতন পাচ্ছেন বিআরটিসির শ্রমিকরা।
নতুন করে ৩০টি বাস যোগ হলেও তার রাজস্ব ও মুনাফার হিসেব কারও কাছে নেই। এছাড়া রমিজ উদ্দিন স্কুলে দেওয়া চারটি বাসও ডিপোতে যুক্ত হয়েছে। বিআরটিসি প্রধান কার্যালয় থেকে নতুন চারটি বাস দেওয়া হয়েছে রমিজ উদ্দিন স্কুলে। এ হিসাবে ডিপোতে বাস সংখ্যা বাড়লেও রাজস্ব বাড়েনি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নতুন বাসগুলো রাতে ডিপোতে থাকলেও দিনে এগুলো চলে বহিরাগতদের পরিচালনায়। তারাই দিনশেষে মুনাফা নিয়ে যায়। ডিপো যে টাকা পায়, তার পরিমাণ খুবই সামান্য। এই ডিপো থেকে উত্তরা-বাড্ডা হয়ে মতিঝিল রুটের এসি বাস চলছে বহিরাগত একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। কাউন্টারে তাদের লোক টিকিট বিক্রি করে। কাউন্টারে টিকিট কাটা লোকজন জানান, তারা খিলক্ষেত ছাত্রলীগের নেতা সাদিকুর রহমান শিপুর লোক।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ডিপো ম্যানেজার মশিউর জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিপোতে বাস চালানোর মতো লোক নেই। এজন্য বাইরের লোক রাখতে হয়। বিআরটিসি ডিপোর একজন কন্ডাক্টরকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। এখন সে যদি বাইরের কাউকে দিয়ে বাস চালায়, সেটা তার বিষয়।’
আর পুরাতন বাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চালক সংকট আছে। নতুন বাস আসায় আয় আগের চেয়ে বেড়েছে। আগামীতে বেতন হবে সব শ্রমিকের।
বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিপোর চালকরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় চালক সংকট তৈরি হয়েছে। নতুন চালক নিয়োগ দেওয়া গেলে ওই ডিপোর সব বাস চালানো যাবে।
ডিপো ঘুরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুরাতন বাসগুলো ডিপোতে অলস বসিয়ে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাস্তায় চলাচল উপযোগী এসব বাস বসিয়ে রাখায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
আন্দোলনের কারণে ঢাকার বাইরে শ্রমিক বদলি করে দেওয়ায় প্রায় একমাস ডিপোতে বাস চালাননি শ্রমিকরা। আগের বিআরটিসি চেয়ারম্যান কেবল বেতনের দাবিতে আন্দোলনে কারণে ডিপোতে ৪০ জনের বেশি চালককে বদলি করেছেন ঢাকার বাইরে। তাদের এখন আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বকেয়া বেতনের দাবিতে এখনো আন্দোলন করছেন জোয়ার সাহারা ডিপোর শ্রমিকরা। বার বার শ্রমিক আন্দোলন ও বেতনের দাবিতে ডিপোতে তালা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এই ডিপোতে। এ ডিপোর শ্রমিকরা এখন ১০ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। আবার প্রায় ১২ মাস বেতনহীন গাবতলী ডিপোর চালক শ্রমিকরা। একই অবস্থা মতিঝিল, মোহাম্মদপুর ও নারায়াণগঞ্জ ডিপোতেও।
নতুন বিআরটিসি চেয়ারম্যান এহছানে এলাহী যোগ দিয়েই ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতি মাসে বেতন না দিয়ে তিনি যাবেন না। তার প্রধান লক্ষ্য থাকবে শ্রমিকদের বেতন নিয়মিত দেওয়া।
বুধবার তৃতীয় পর্বে পড়ুন-
সিন্ডিকেট চালাচ্ছে বিআরটিসি বাস, লাভের ভাগ কর্মকর্তাদের পকেটে