শাহাজাহানপুর রেল কলোনি: ঝুপড়ির আড়ালে অপরাধের আখড়া
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:০৭
ঢাকা: মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ইভটিজিং— হেন কোনো অপরাধ নেই, যার দেখা মিলবে না রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এটি আবাসিক এলাকা হলেও এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ঝুপড়ি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগাতেই দিনের পর দিন এসব ঝুপড়িতে চলছে অপকর্ম। এখানকার ‘সিন্ডিকেট’ এতই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি নিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে এই কলোনির অবৈধ সব স্থাপনা।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু করে বিকেল ৩টা পর্যন্ত শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে অভিযান চালায় বাংলাদেশ রেলওয়ের এস্টেট ডিপার্টমেন্ট। রেলওয়ে ল্যান্ড ও এস্টেট ডিভিশনের ডিভিশনাল এস্টেট অফিসার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে অভিযানে কোনো অবৈধ স্থাপনাকেই আস্ত রাখা হয়নি।
স্থানীয়রা বলছেন, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে আবাসিক ভবন রয়েছে প্রায় ৩০০টি। এসব ভবনে যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থাকার জন্য বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাদের বেশিরভাগই এখানে থাকেন না। বাইরের লোকদের কাছে এসব বাসা ভাড়া দিয়ে তারা অন্য জায়গায় থাকেন। ভাড়াটিয়া ‘বহিরাগতরা’ই এসব ভবনের আশপাশের জায়গায় টিনের চালা ও ছাদ ঢালাই করে ঘর তৈরি করে অবৈধভাবে ভাড়া দিয়ে আসছিল। এসব ঝুপড়ি ঘরে মাদকের আড্ডা বসত সন্ধ্যার পর, হরহামেশাই হতো ছিনতাই। আশপাশের দোকানগুলোতে চাঁদাবাজি ছিল নিত্যকার ঘটনা। দিনের বেলায়ই ইভটিজিংয়ের শিকার হতেন নারীরা। অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংযোগের মতো অব্যবস্থাপনাও দীর্ঘদিনের বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই রেলওয়ে কলোনির ৩০০ ভবনের প্রতিটিতে আলাদা করে বাউন্ডারি দেয়াল আছে। দেয়ালের ভেতরে বেশ ফাঁকা জায়গাও ছিল একসময়। কিন্তু স্থানীয়রা এসব ফাঁকা জায়গায় ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। ফলে এসব ভবনের বাসিন্দারা বস্তির মতোই বসবাস করে আসছেন। ছেলে-মেয়েরাও আর মন খুলে খেলতে পারে না, পারে না বেড়াতে। কলোনির পুরোটাই নোংরা ও স্যাঁতস্যাঁতে।
রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকের অভিযোগ, তাদের নামে এই কলোনিতে বাসা বরাদ্দ থাকলেও বিভিন্ন ‘বাস্তব কারণে’ই তারা অন্য এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকছেন। আর কলোনির বরাদ্দ পাওয়া বাসা অন্য কাউকে ভাড়া দিয়েছেন।
ফারুক হোসেন নামে রেলের একজন কর্মচারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে এই কলোনিতে আছি। ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে, তবে ভালো মানুষ হতে পারেনি। এখানকার পরিবেশে মিশে নষ্ট হয়েছে। এসব দেখে অনেকেই ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতেই অন্য জায়গায় চলে গেছে।
ফারুক আরও বলেন, এখানে নোংরামি হয়। ভবনগুলোতে হিজরা উঠেছে। তাদের অত্যাচারে থাকা দায়। আবার অনেক বহিরাগত ২০/৩০ বছর ধরে বাস করছে। তাদের ক্ষমতাই এখানে বেশি। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে।
আম্বিয়া বেগমের বাবা চাকরি করতেন রেলওয়েতে। বাবার চাকরির সূত্রে তার জন্ম এই শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। এখানেই বাস করছেন ৪৫ বছর ধরে। আম্বিয়া বলেন, এখানে সবধরনের অপরাধ হয়। মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। তারা যেখানে সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দেয়। বিভিন্ন মাজারের নামে আসর বসায়।
শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে চলছে উচ্ছেদ অভিযান
বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ, মুজিব ভাণ্ডার মঞ্জিল, বাংলাদেশ রেলওয়ে বৈদ্যুতিক শ্রমিক কর্মচারী পরিষদ, বাংলাদেশ রেলওয়ে কারিগর পরিষদ, গাউছিয়া মুজিবিয়া খানকা শরীফ— এরকম বেশকয়েকটি সংগঠনের সাইনবোর্ড দেখিয়ে দিয়ে স্থানীয়রা বলেন, এসব সাইনবোর্ডের ব্যানারে রেলের অনেক কর্মচারী ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। আবার অনেকে আছেন যারা রেলের কেউ নন, তারাও ভাড়া দিয়েছেন। তবে বহিরাগতের সংখ্যাই বেশি।
অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় খন্দকার সরোয়ার আলম বলেন, ‘প্রতিটি ভবন থেকে বাইরের ঝুপড়ি ঘরগুলোতে লাইন দেওয়া হয়েছে। আবার অনেকে সরাসরি বিদ্যুতের খুঁটি থেকে লাইন নিয়েছে। গ্যাস ও পানির লাইনও আছে অবৈধভাবে। লাইনম্যান আছে, তারা এসব ঘরের টাকা তুলে থাকে।’
টাকা তোলার পর কার কাছে জমা হয়— জানতে চাইলে সরোয়ার আলম বলেন, ‘স্থানীয় যুবলীগের রাজা, রিজভী, সাত্তার, হারুন, শ্রমিক লীগের কবিরুল, তাহের, জয়, হৃদয় আর ছাত্রলীগের অভি, নাহিদ, ছোটন নামের বেশ কয়েকজন এসব টাকার ভাগ নেয়। এদের বাইরে অনেকেই এই কলোনিতে টাকা তুলে থাকে।’
সরোয়ার আলম আরও বলেন, ‘সন্ধ্যার পর মাদকের আখড়া বসে। বেচাকেনা চলে প্রকাশ্যে। পুলিশ এখানে দর্শকের ভূমিকা পালন করে।’
তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে শাহজাহানপুর থানার একজন কনস্টেবল বলেন, ‘নেতাদের কারণে আমরা অসহায় হয়ে থাকি। কিছু করলেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিচার দেন নেতারা। তাই কিছু বলে না পুলিশ।’
ইভটিজিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ৪৭ ভবনের বাসিন্দা রাবেয়া বেগম রত্না বলেন, ‘দুপুরের দিকে স্কুল ছুটি হলে মেয়েরা যখন আসতে শুরু করে, স্থানীয় ছেলেরা দলবেঁধে টিজ করতে থাকে। অনেক সময় বাসার গেট পর্যন্ত আসে পিছে পিছে। আবার বিকেল বেলা বাসার গেটের সামনে বখাটেদের ভিড় দেখা যায়। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, কখন কোন মেয়ে বের হয়। অনেকটাই বন্দি জীবন কাটাতে হয় আমাদের।’
রাবেয়া বেগম আরও বলেন, ‘খেলার একটি মাঠ রয়েছে সেখানেও স্থানীয়রা রিকশা ভ্যান কিনে গ্যারেজ বানিয়েছে। অনেকে মালামাল রাখে। ফলে কেউ খেলতে পারে না।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল হক সারাবাংলা বলেন, ‘আমরা যখনই অভিযান চালানোর উদ্যোগ নিয়েছি, তখনই রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয় দিয়েছে। তারা বলেন, এটা রেলের এলাকা। এখানে পুলিশের খবরদারি মানায় না। এরপরও আমরা অনেক অভিযান চালিয়েছি। অনেককে গ্রেফতার করে জেলেও পাঠিয়েছি। তবে আজকের অভিযান আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনেক কাজে লাগবে।’ এছাড়া কেউ অভিযোগ দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা আমলে নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে রেলওয়ের ডিভিশনাল অফিসার (এস্টেট) মো. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গত সাত মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছি। কাউকে ছাড় দেইনি। উচ্ছেদের সময় কেউ বাঁধাও দিতে আসেনি। আগামী সাত দিনের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান শেষ হবে। পুরো এলাকা হবে পরিকল্পিত ও বসবাসের উপযোগী। এরপর যারা অবৈধভাবে স্থাপনা তৈরি করবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তাছাড়া তদারকিও করা হবে।’
ভবনগুলোর ভেতরে যারা বাস করছেন তাদের অনেকেই বহিরাগত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না— জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়টি অন্য আরেক কর্মকর্তা (ইঞ্জিনিয়ার বিভাগ) দেখে থাকেন। এরপরও আমরা এ বিষয়ে চিঠি দেবো— যাদের অ্যালটমেন্ট করা হয়েছে, তারাই যেন শুধু থাকে। বহিরাগত কেউ যেন ভবনগুলোতে থাকতে না পারে, সেজন্য চিঠি লেখা হবে।’