খালেদের ক্যাসিনোতে প্রতি রাতে লেনদেন হতো কোটি টাকা!
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:০০
যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া মালিকাধীন ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রতিদিন লেনদেন হতো কোটি টাকা। কখনও কখনও সংখ্যাটা কয়েক কোটি টাকায় গড়াতো। দুই শিফটে চলা এ ক্যাসিনো ক্লাবটিতে গড়ে প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ ব্যক্তি জুয়া খেলতেন। আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল নিয়মিত জুয়াড়ি। তারা প্রত্যেকে গড়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করতেন ক্যাসিনোতে। তবে ক্লাবটিতে ভিআইপিরা জুয়া খেলতেন সর্বনিম্ন ২০ লাখ টাকার স্টেকে।
রাজধানীতে ক্লাবের নামে ক্যাসিনো পরিচালিত (জুয়া খেলা) হচ্ছে এমন অভিযোগে মতিঝিলের ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান পরিচালনা করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ সময় উপস্থিত ১৪২ জনকে আটক করা হয়।
জানা যায়, ইয়ংমেনস ক্লাবটিতে তিন ক্যাটাগরিতে চলত ক্যাসিনো বা জুয়া খেলা। যাদের টাকার পরিমাণ কম তারা শুধু বোর্ডে খেলতে পারত। আর যাদের মোটামুটি টাকা আছে তাদের বোর্ড এবং ডিজিটাল মেশিনে খেলার সুযোগ ছিল। অর্থাৎ যাদের টাকার পরিমাণ প্রতি স্টেক বা বিটে (খেলোয়াড়দের ভাষায়) ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা তারা শুধুমাত্র বোর্ডে খেলত পারতো। আর যারা ২০ হাজার থেকে লাখ টাকার সামর্থ্য ছিল তারা নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী দুটিতে খেলার সুযোগ ছিল। আর যাদের তারও বেশি টাকার সামর্থ্য রয়েছে তাদের জন্যও ছিল ভিআইপি গ্যালারি। যেখানে সর্বনিম্ন ২০ লাখ টাকার স্টেকে খেলা হতো।
ক্লাবটিতে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দিনের বেলা এবং রাত আটটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত রাতের বেলায় এ দুই শিফট অনুযায়ী খেলা হতো। দিনের শিফটে ৫০-৬০ জন এবং রাতের শিফটে একশ থেকে দেড়শ লোক হতো। এতে রাতের শিফটেই খেলতে আসতেন ভিআইপিরা। আর দিনের বেলায় আসতেন নিম্ন শ্রেণির (ক্লাবের ভাষায়) খেলোয়াড়রা। তার মধ্যে কেউ কেউ টাকা আয়ের জন্য নয়, মানসিক আয়ের জন্য নয়, নেশা বা মানসিক প্রশান্তির জন্যও টাকা ওড়াতে আসতেন এ ক্লাবে।
খালেদের ক্যাসিনোতে মাস দেড়েক ধরে খেলা শুরু করেছেন ছিদ্দিকুর নামে এক যুবক। এর আগে তিনি মুক্তিযুদ্ধা সংসদ ও ওয়ান্ডারাস ক্লাবসহ আরও বেশ কিছু ক্লাবে জুয়া খেলেছেন। সেসব ক্লাব থেকে খেলা শেখার পর অনেকের মতো তিনিও দেড় মাস ধরে ইয়ংমেনস ক্লাবে খেলছেন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত দেড় মাস ধরে খেলছি। কখনও পাইছি আবার কখনও হারায়ছি। তবে এটা তো নেশা। জিতলেও খেলতে ইচ্ছে করে হারলেও খেলতে ইচ্ছে করে। কখনও লোভ, কখনও হিংসা আবার কখনও ক্ষোভ থেকেও খেলতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যে সবাই শুধু টাকার লোভে খেলতে আসে তাও কিন্তু না। কেউ কেউ মানসিকভাবে ভালো থাকতেও খেলতে আসেন। তারা যখন কোনো বিটে জেতেন তখন সে টাকাগুলো যারা হেরে যান এমন গরিব খেলোয়াড়দের দিয়ে দেন। তারা শুধু জেতার আনন্দ উপভোগ করেন।
ক্লাবটিতে স্টাফ হিসেবে কাজ করতেন শামছুল হক। র্যাবের অভিযানে তিনিও ধরা পড়েছেন। শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দিনের চেয়ে রাতের বেলায় ক্লাবটিতে প্রভাবশালীরা খেলতে আসেন। তাদের বেশিরভাগ ভিআইপি। একেকজন ২০ লাখ, ৫০ লাখ টাকা বেট ধরেন। মতিঝিলে এ ক্লাবটি একটু বেশি সেরা। কারণ এখানে বিদেশিরাও খেলতে আসেন। আবার বোর্ড চালায় বিদেশিরাই।’
র্যাবের হাতে জব্দ হওয়া কাগজপত্রেও শামছুল হকের কথার কিছু প্রমাণ মিলেছে। ক্লাবের প্রতিদিন খেলোয়াড়দের টাকার নির্দিষ্ট কাগজপত্রে দেখা যায়, কেউ ১৮ লাখ টাকা নিয়ে শুরু করেছেন কেউবা ১৩ লাখ টাকা। এসব কাগজে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কত টাকা কখন জিতেছে, কে হেরেছে সব তথ্য উল্লেখ রয়েছে। আর এমন প্রায় অর্ধশতাধিক কাগজ জব্দ করেছে র্যাব।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্টেট সারওয়ার আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এখনও জানা যায়নি ক্লাবটিতে প্রতিদিন কী পরিমাণ অর্থ লেনদেন হতো। তবে তাদের কার্যক্রম দেখে ধারণা করা হচ্ছে, কোটি টাকা হতেও পারে। কারণ এটিতে ছিল টাকা গণনার মেশিন। বিপুল টাকার লেনদেন না হলে তো এ মেশিন লাগত না। তবুও এটি তদন্তের ব্যাপার।’
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেন, ‘এ ক্যাসিনোতে দুইজন চীনা ও নেপালি পেয়েছি। তারা দাবি করেছেন, এখানে মাসিক বেতনে চাকরি করেন। তবে আদৌও তাদের ওয়ার্ক পারমিট আছে কি না সেটি আমরা খতিয়ে দেখছি। যদি কাজ করার বৈধতা থাকে তাহলে ছাড় পাবে। আর যদি না থাকে তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। তারা আপাতত নজরদারিতে থাকবে।’
ক্লাবটি থেকে আটক ১৪২ জনের মধ্যে ৩১ জনের ১ বছর এবং ১১১ জনের ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে ২৫ লাখ টাকা এবং বিপুল পরিমাণ মদ-বিয়ারসহ বিভিন্ন মাদক জব্দ করা হয়েছে।
ক্রীড়া ক্লাবের অন্তরালে ক্যাসিনো, কী বলছে স্থানীয়রা?
ইয়ংমেনস ক্লাবে হঠাৎ র্যাবের অভিযান দেখে রীতিমত বিস্মিত স্থানীয়রা। তারা বলছেন, ক্লাবটির সামনেই মতিঝিল থানা। থানার পেছনেই এমন অবস্থা বিষয়টি অনেকেই জানতে পারেনি।
আবু বকর নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘কমলাপুর স্টোডিয়ামের পাশেই আমাদের বাসা। ছোট বেলা থেকেই এসব অলিগলিতে বড় হয়েছি। সে সময় থেকে এ ক্লাবটা দেখেছি। গত পাঁচ-ছয় বছর আগেও ক্লাবটির নাম ছিল ফকিরাপুল ক্লাব। কিন্তু তারপর থেকে বছর পাঁচেক হবে ফকিরাপুল ক্লাবের নাম হয়ে গেছে ইয়ংমেনস ক্লাব। সে সময় কয়েকমাস ক্লাব বন্ধ ছিল। আগে ভেতরে দাবা, কেরাম, টেনিসসহ নানা খেলা হতো। কিন্তু ক্লাবের নাম পরিবর্তনের পর ফের যখন চালু হল তখন আর আমরা ঢুকতে পারতাম না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তখন আমরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে গার্ডরা আমাদের ঢুকতে দিত না। বলত এখানে নামি-দামি খেলোয়াড়রা ছাড়া বাইরের লোক ঢোকা নিষেধ। তাই আমরা ঢুকতে চাইতাম না। কিন্তু এখন যেটি শুনলাম, তাতে তো নিজেও বিশ্বাস করাতে পারছি না। থানার পেছনেই এ কাণ্ড।’
একই কাণ্ড ওয়ান্ডারার্স মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে!
রাতে খালেদের ইয়ংমেসন ক্লাবে অভিযানের পর র্যাব অভিযান চালায় পাশের আরেকটি ক্যাসিনো ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও গুলিস্তানের পীর ইয়ামেনি মার্কেটের পাশের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র নামে একটি ক্লাবে। ক্লাব দুটিতেও ছিল জুয়ার আসর। অভিযানে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব থেকে কাউকে আটক করা যায়নি। তবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র থেকে ৪০ জনকে আটক করা হয়।
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবেও ছিল তিনটি ডিজিটাল ক্যাসিনো বোর্ড ও সাতটি সাধারণ বোর্ড। এখান থেকে জব্দ করা হয়েছে ১০ লাখ ২৭ হাজার নগদ টাকা ও বিপুল পরিমাণ মদ ও বিয়ার এবং হিরোইন সাদৃশ্য বিভিন্ন মাদক দ্রব্য। ক্লাবটির মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলহাজ্ব মোমিনুল হক সাঈদ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা আবু কাউসার।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র নামের ক্লাবটিতে দেখা যায়, ক্যাসিনো খেলার সাধারণ তিনটি বোর্ডসহ জুয়া খেলার নানা সরঞ্জাম। এ ক্লাব থেকে ৪০ জনকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয় নগদ ৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে জব্দ করা হয় কষ্টি পাথরের মূর্তি ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। ক্লাবটি বর্তমানে যুবলীগের সভাপতি ইসমাঈল চৌধুরী সম্রাট পরিচালনা করেন বলে জানা গেছে।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. শাফিউল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নামে ক্রীড়া সংগঠন হলেও কাজে তারা জুয়ার আসর গড়ে তুলেছেন।’
সিও বলেন, ‘ওয়ান্ডারার্স ক্লাব থেকে সবাই পালিয়ে যাওয়ার পরও ১০ লাখ ২৭ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, কত টাকা লেনদেন হতো এসব ক্যাসিনোতে। যদিও এসব তদন্তসাপেক্ষ ব্যাপার। তবুও বলতে হয়, এখানে যে পরিমাণ টাকা প্রতিদিন লেনদেন হতো তার সংখ্যা অবশ্য কম নয়।
আটক ক্যাসিনো জুয়া ফকিরাপুল মতিঝিল ম্যাজিস্ট্রেট যুবলীগ র্যাব