থমকে গেছে জীবন নাজিমউদ্দিন রোডে
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৫:৪৮
আরিফুল ইসলাম ও মাকসুদা আজীজ
ঢাকা: রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের একপাশে চকবাজার, আরেক পাশে বেচারাম দেউড়ি। অন্য পাশে চানখারপুল। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো যুক্ত সরু কিছু রাস্তা দিয়ে। আর সবকিছুর মধ্যমণি হচ্ছে, পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার।
এই পথ সবসময় পরিচিত তার স্বাভাবিক যানজটের জন্য। এই হয়ত চকবাজারে মালের বড় একটা চালান এলো, ওই বুঝি বসল হরেক পণ্যের বাজার। হয়ত আজ নান্নার বিরিয়ানিতে বড় কোনো অর্ডার আছে। ঢুকে গেল কয়েকটা ভ্যান।
এর বাইরে গায়ে গায়ে লাগানো বাড়িগুলোর মানুষের স্বাভাবিক চলাচল তো আছেই। কারাগারের উঁচু প্রাচীরের কোল ঘেঁষে ফার্নিচারের দোকান, খাবারের দোকান, তাদেরই কি কম ব্যস্ততা?
এর মধ্যেই কখনও-সখনও জেলখানাকে ঘিরে শুরু হয় চাঞ্চল্য। হয়তো কোনো মামলার রায় কার্যকর হচ্ছে অথবা গুরুত্বপূর্ণ কেউ জেলে ঢুকল। আর কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আত্মীয়দের নিয়মিত চাপ তো থাকতই।
২০১৬ সালে এ কেন্দ্রীয় কারাগার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে কেরানীগঞ্জে নেওয়ার পরে কারাগারকে ঘিরে ব্যস্ততা কমলেও এলাকা জুড়ে সব সময়ই লেগে থাকে ব্যস্ততা। ছিল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্তও।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ড পান বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নিরাপত্তার স্বার্থে কাশিমপুর না রেখে তাকে রাখা হয় পরিত্যক্ত এই কারাগারে, যা আসলে একটি জাদুঘর হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল।
খালেদা জিয়ার কারাবাসকে ঘিরেই এখন আবর্তিত হচ্ছে এ এলাকার মানুষের জীবন। খালেদা একা নয় তার সঙ্গে কার্যত বন্দিযাপন করছেন পুরো এলাকাবাসী।
কারা ফটককে সংযোগকারী রাস্তার মুখে বসানো হয়েছে ব্যারিকেড। দুই পাশসহ চারটি সড়ক এছাড়াও নাজিম উদ্দিন সড়ক, জেলখানার ঢাল, হাজী টাওয়ারের সামনের রাস্তা, বেগমবাজার মোড়, আবুল হাসনাত রোডেও ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। এই ব্যারিকেড গলে কাকপক্ষীর এপার-ওপার হওয়ার ঘটনাও পর্যবেক্ষণ করতে হাজির প্রহরীরা।
কারারক্ষীরা তো বটেই, পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স যুক্ত করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। গলির মোড়ে, বাড়ির ছাদে, হয়ত কোনো বাড়ির বারান্দাতেও দেখা মিলবে একজন দুইজন পুলিশের।
বাসিন্দারাও যাপন করছে বন্দিজীবন। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকেই বের হন না। যদি কেউ বের হয়েই যান বাড়িতে থাকা কেউ বসে থাকেন ফোন হাতে। ব্যারিকেড গলে আবার ভেতরে ঢুকতে হলে ফোন করতে হবে বাসায়, পুলিশ কথা বলে নিশ্চিত হলেই কেবল ঢুকতে দেওয়া হবে ভেতরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসিন্দা বলেন, আজকে তিন দিন ধরে বাড়িতে বন্দি। প্রয়োজন ছাড়া বারান্দায়ও বের হওয়া যায় না। সব সময়ই কেউ না কেউ দেখছে আপনাকে। জানালার পাশেও দাঁড়াতে ভয় লাগে। থমথমে পরিবেশ, একটা গাড়ি আসলেও মনে হয় যেন ভয়ঙ্কর কিছু হবে।
প্রবীণ আরেক বাসিন্দা জানান, জেলের পাশে থাকি আজ ৫৬ বছর। অনেক কিছুই দেখেছি। এভাবে থমকে যাওয়ার ঘটনাও এখানে নতুন নয়। তবে এতদিন ধরে এমন কখনও হয়নি, এবারই হলো।
কারাগারের উল্টোপাশের ফার্নিচারের দোকানগুলো আজ তিনদিন ধরে বন্ধ। কবে খোলা হবে জানে না কেউ। আদৌ খোলা হবে কি না তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। এসব দোকান ঘিরে যাদের জীবিকা তারা এটা জানতে চায় না খালেদা জিয়ার সাজা কার্যকর হবে কি না? খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হবে কি না। তাদের শুধু একটাই চাওয়া, এ স্থবির জীবনের অবসান হোক!
নাজিমউদ্দিন রোডের দোকানদার শাওন বলেন, আমাদের ব্যবসায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। দোকানের পণ্য আনতে পারছি না, আর কাস্টমার অনেক কমে গেছে। রাত ১০ আগে দোকান বন্ধ করতে হয়। পণ্য না থাকায় কাস্টমাররা ফেরত যাচ্ছে।
এক কার্গো ব্যবসায়ী মানিক বলেন, আজ তিন ধরে কার্গো না আসায় ব্যবসা বন্ধ।
তিনি আরও বলেন, এই নাজিমউদ্দিন রোডের সঙ্গে যুক্ত পথগুলোতে পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ আছে। সড়কটি দিয়ে বাণিজ্যিক সংযোগ চকবাজার, বেগমবাজার, মনিবাজার জল্লাবাজারসহ রাজধানীর অনেকগুলো পাইকারি বাজারের
এমন স্থবির পরিস্থিতিতেই আসে শনিবার। দেশজুড়ে চলছে এসএসসি ও ভোকেশনাল পরীক্ষা। আজ ছিল সাধারণ গণিত। স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষার্থীদের বের হতে হয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। ব্যারিকেডে আটকানো হয়েছে তাদেরও। তল্লাশী থেকে মাফ যায়নি তারাও। স্টুডেন্ট আইডি দেখে দেখে ঢুকতেও বের হতে দেওয়া হয় তাদের।
এই স্থবির জীবনে একমাত্র চাঞ্চল্য কারাগারকে ঘিরে, সারাদেশ এমনকি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও ক্ষণে ক্ষণে জানতে চায়, কী হচ্ছে এখানে। তবে সংবাদকর্মীদের থাকতে হচ্ছে ব্যারিকেডের বাইরেই। এই বিষয়ে ডিউটিরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ বলেন, মূল ফটকের সামনে কোনো সাধারণ মানুষ এবং সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। মূল ফটকের সামনে প্রবেশ করতে হলে, কমিশনারের লিখিত অনুমতি লাগবে।
সারাবাংলা/এআই/জেএ/এমএ