জালিয়াতি করে নিজের নামেও এনআইডি বানিয়েছিলেন ইসি কর্মী
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:১৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেওয়ার মামলায় গ্রেফতার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অস্থায়ী কর্মচারী মোস্তফা ফারুকের কাছে তার নিজের দু’টি এনআইডি পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোস্তফা ফারুক একই ঠিকানা ব্যবহার করে শুধু সামান্য নাম পালেট নিজে আরেকটি এনআইডি তৈরি করেছিলেন। দু’টি এনআইডির তথ্যই নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নেওয়া মোস্তফা ফারুককে শুক্রবার এ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতার দেখায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তার কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) লাইসেন্স করা একটি ল্যাপটপ, মডেমসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। বাসায় তল্লাশিতে তার দু’টি এনআইডি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় একই নামে ও একই ছবিতে মোস্তফার দুটি এনআইডি আমরা পেয়েছি। দুইবার ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হওয়া এবং দুটি এনআইডি গ্রহণ করা আইনত অপরাধ। সে নিজেই দ্বিতীয়বার এনআইডি তৈরি করেছে বলে জানতে পেরেছি। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’
গ্রেফতার মোস্তফা ফারুক (৩৬) ফেনী সদর উপজেলার দমদমা গ্রামের মো. ইলিয়াছের ছেলে। তিনি আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় ‘ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম-২০১৯’ এর কাজ করছিলেন।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুটি এনআইডির একটিতে নাম ‘মো. মোস্তফা’ এবং আরেকটিতে ‘মো. মোস্তফা (ফারুক)’ উল্লেখ আছে। দুটিতেই বাবার নাম- মো. ইলিয়াছ এবং মায়ের নাম- লুৎফুন নেছা উল্লেখ আছে। জন্মসালও একই- ২ জানুয়ারি, ১৯৮৩। রক্তের গ্রুপও একই– (এ+)।
মো. মোস্তফা নামে বানানো এনআইডির নম্বর- ১৪৬০৬৫১৫২২। ঠিকানা উল্লেখ আছে- চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচলাইশ থানার আমিন জুট মিলস-৪২১১ ডাকঘরের মোমেনবাগে ৩ নম্বর হাজী শফি বিল্ডিং। ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই এনআইডি তিনি পান এবং এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ উল্লেখ আছে ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০।
মো. মোস্তফা (ফারুক) নামে বানানো এনআইডি তিনি পেয়েছেন ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর। এই এনআইডিতে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ উল্লেখ নেই। ঠিকানাও একই। এনআইডি নম্বর- ১৫৯৫৭০৭৭২৫৬০৫।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মোস্তফা নিজেই স্বীকার করেছে, প্রকৃত এনআইডি থাকার পরও সে নিজের ইচ্ছায় নিজেই আরেকটি এনআইডি বানিয়েছে। ২০০৮ সালে প্রথম এনআইডি স্বাভাবিকভাবেই সে পায়। ২০১৪ সালে সে নির্বাচন কমিশনের প্রকল্পে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে যুক্ত হয়। ২০১৮ সালে সে এই এনআইডি তৈরি করে।’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের একটি প্রকল্পের অধীনে মোস্তফা ফারুক ২০১৬ সালে কোতোয়ালী থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেসময় হাবিব উল্লাহ সওদাগর নামে এক ব্যক্তিকে নগরীর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড থেকে ভোটার হওয়ার আবেদন করেছিলেন। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়ায় তৎকালীন কোতোয়ালী থানা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ তার আবেদন ফরমটি বাতিল করেন। কিন্তু মোস্তফা ফারুক নিবন্ধন ফরম নম্বর পরিবর্তন করে ওই ব্যক্তিকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেন এবং ওই ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেন। মোস্তফা ফারুকের মতো কর্মচারী অফিসের কাজের জন্য হুমকিস্বরূপ উল্লেখ করে আব্দুল লতিফ শেখ তার বিরুদ্ধে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন দেন। ২৯ জুন এ সংক্রান্ত প্রকল্পের উপ-পরিচালক মো. ইলিয়াস ভূঁইয়া তাকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোতোয়ালী থানা নির্বাচন কর্মকর্তার অধীনে কাজ করেছিলেন ‘মোস্তফা ফারুক’ নামে। প্রত্যাহারের পর ২০১৯ সালের ১১ জুন তিনি আবারও আনোয়ারা উপজেলা, ১৩ জুন কর্ণফুলী উপজেলা এবং ৩ জুলাই রাউজান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অধীনে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট হিসেবে অস্থায়ী নিয়োগ পান। এই তিনটি উপজেলায় নিয়োগের সময় তার নাম ‘মোস্তফা ফারুক’ উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এর আগে ২ জুলাই রাঙ্গুনিয়া উপজেলা এবং ২ সেপ্টেম্বর বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অধীনে একই দায়িত্ব পান, যেখানে তার নাম উল্লেখ আছে ‘মো. মোস্তফা’।
দু’টি এনআইডি ব্যবহার করে মোস্তফা ফারুকের জালিয়াতি তদন্ত করে দেখার কথা জানিয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা।
হারিয়ে যাওয়া নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্স করা ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্তি এবং এনআইডি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রেফতার করা হয় তিনজনকে। এরা হলো- ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহকারী জয়নাল আবেদীন ও তার ঘনিষ্ঠ দুজন বিজয় দাশ এবং সীমা দাশ ওরফে সুমাইয়া। তাদের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। রাতেই কোতোয়ালী থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা হয়।
ওই মামলায় জয়নালকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোস্তফা ফারুককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া।
রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডি: গ্রেফতার ইসি কর্মী ৫ দিনের রিমান্ডে
রাজেশ সারাবাংলাকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া গেছে- জয়নাল আবেদীন রোহিঙ্গা নাগরিকদের সংগ্রহ করত, যারা বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হয়ে এনআইডি পেতে আগ্রহী। জয়নাল নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্স করা ল্যাপটপে নির্দিষ্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফরম পূরণ করত। ছবি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, স্বাক্ষর সংযুক্ত করে ‘ডেট ফাইল’ তৈরি করে দিত মোস্তফা ফারুককে। এরপর ফারুক নির্বাচন কমিশনের ইন্ট্রানেট মোডেম ব্যবহার করে সার্ভারে সেই তথ্য ইনপুট দিত। এভাবে একজন রোহিঙ্গা পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্র।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মোস্তফা ফারুকের কাছ থেকে উদ্ধার করা ল্যাপটপে রোহিঙ্গাদের একটি ডাটাবেইজ পাওয়া গেছে, যেখানে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার নাম ও নানা তথ্য আছে। এছাড়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মোস্তফা ৯ জনের নাম বলেছেন, যারা নির্বাচন কমিশনের স্থায়ী ও প্রকল্পভিত্তিক কর্মচারী।