ডিঙিউথা হাওরে মাছের আকাল, ৫ হাজার জেলে পরিবারের দুর্দিন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:০৪
নেত্রকোনা: একসময় নেত্রকোনার বৃহত্তম হাওর ডিঙিউথা ছিল মাছের রাজ্য। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করেও এই হাওর থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ চলে যেত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চিত্র বদলে গেছে।
ডিঙিউথা থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ। আবার আইন ভঙ্গ করে নিষিদ্ধ সময়ে পোনা ও মা মাছ ধরার কারণে ভরা মৌসুমেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না মাছ। তাতে করে স্থানীয়দের মাছজাতীয় আমিষের যেমন ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে এই হাওরের মাছের ওপরই নির্ভরশীল পাঁচ হাজার জেলে পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর দুর্দিন।
ভাটি বাংলা নেত্রকোনার বিশাল ডিঙিউথা হাওর বর্ষার ছয় মাস থাকে অথৈ জলে পরিপূর্ণ। স্থানীয়রা বলছেন, এই হাওরের দারকিনা, নানিদ, মাশুল, লাচো, কালিবাউশ, পাবদা, চিংড়ি, বাতাসি, বোয়াল, বাঁশপাতা, বাঁচা, বাঘাইড়, মাগুর, চাপিলা মাছের স্বাদ অনন্য। সেগুলোর চাহিদাও ছিল আকাশচুম্বী। তবে এসব মাছের দেখা আর মেলে না বললেই চলে।
এর কারণ হিসেবে জেলেরা দায়ী করছেন আধুনিক মাছচাষ পদ্ধতি, জমিতে যথেচ্ছভাবে সারের ব্যবহার, কীটনাশক প্রয়োগ, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, পোনা ও মা মাছ নির্বিচারে ধরা, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরার মতো প্রবণতাকে। আর এর জন্য ভুগতে হচ্ছে তাদেরই।
জেলেরা বলছেন, এসব মাছ বিলুপ্তির পথে থাকায় এবং অন্য মাছের উৎপাদনও কমে যাওয়ায় হাওর পাড়ের খুরশিমুল, সিয়াদার, বলদশি, রামপাশা, তেতুলিয়া, পুঁটিউগা, চেছরাখালি, শামপুরসহ প্রায় ২৫টি গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ থেকে। মাছের দেখা না পাওয়ায় আর জেলে পরিবারগুলোও ভুগছে কর্মহীনতায়।
স্থানীয়রা বলছেন, ১৯৮৫ সালে প্রণীত মৎস্য সংরক্ষণ আইনে বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১২ ইঞ্চির নিচে মাছ ধরা ও পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবার ১ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শৈল, গজার ও টাকি মাছের পোনার ঝাঁক ও দম্পতি মাছ ধরাও নিষেধ। কারণ এই সময়ই বিভিন্ন জলাশয়ের নানা প্রজাতির মাছ ডিম ছাড়ে। তবে আইন থাকলেও নেই যথাযথ প্রয়োগ। ফলে একশ্রেণির মাছশিকারী কারেন্ট জাল ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে নিষিদ্ধ সময়েও মা মাছ, রেণু পোনা ও মাছের ডিম সংগ্রহে তৎপর হয়ে ওঠে। আবার শীতের সময় শ্যালো মেশিন দিয়ে পুকুর-খাল-বিল সেচে মাছ শিকার করে থাকেন তারা। ফলে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ভরা মৌসুমেও জালে উঠছে না মাছ।
জেলেদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় বরাবরই ‘প্রভাবশালী মহল’ জেলেদের নামে হাওরের জলাশয় ও নদীর ভুয়া ইজারা নিয়ে থাকেন। ফলে দরিদ্র জেলেরা এসব জলাশয় ও নদীতে মাছ ধরতে পারেন না। বাধ্য হয়ে এখন অনেক জেলে পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।
খুরশিমুল গ্রামের জেলে পরিতোষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাওর নেতারা ইজারা নেওয়ায় আমরা মাছ ধরতাম (ধরতে) পারি না। শুকনা কাল মাছ থাহে (থাকে) না, তহন না খাইয়া থাহি (তখন না খেয়ে থাকি)। দেশি মাছ বাঁচানির লাইগা সরহারের সাহায্য দরহার (দেশি মাছ বাঁচাতে সরকারের সাহায্য দরকার)।’ তার কথায় একমত পোষণ করলেন বলদশি গ্রামের জগদিশ, সিয়াদার গ্রামের সোহাগ মিয়ার মতো জেলেরা।
এদিকে, হেমন্ত কালে হাওরের পানি শুকিয়ে গেলে জেলেরা বেকার হয়ে পড়েন। তখন তাদের বাঁচতে হয় অর্ধাহারে-অনাহারে। ব্যাংক থেকে বিনা সুদে ঋণ পেলে বিকল্প উপায়ে বেঁচে থাকার পথ সন্ধান করতেন বলে জানান তারা।
মল্লিকপুর গ্রামের রুপন দাস ও তেতুলিয়া গ্রামের হাসেন আলী বলেন, ‘আমরারে বিনাসুদি ব্যাংক ঋণ দিলে জাল-নাও কিনতাম (আমাদের বিনা সুদে ঋণ দিলে জাল-নৌকা কিনতাম)। বউ-পোলাপান নিয়া বড় কষ্ট কইরা বাইচ্যা আছি।’
হাওর অঞ্চলে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দেশীয় প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম স্থাপনসহ প্রচুর পরিমাণে পোনা মাছ ছেড়ে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসী। হাওরবাসী এলাকাটিকে পুনরায় দেশীয় মাছের ভাণ্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীলিপ সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেলেদের পরিচয়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পরিচয়পত্র পাওয়া জেলেদের মধ্যে অসহায় ও দুর্ঘটনায় পড়েছেন— এমন জেলেদের সরকারিভাবে সহযোগিতা দেওয়া হবে।’
অবৈধভাবে পোনা ও মা মাছ ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ‘কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করার জন্য মোবাইল কোর্ট কাজ করছেন। তবে পোনা ও মা মাছ ধরাসহ পানি শুকিয়ে মাছ ধরা এবং জমিতে যথেচ্ছভাবে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধে কৃষকদের সজাগ হতে হবে।’