ক্যাসিনো ছাড়া আর কোনো পেশায় ছিলেন না এনু-রুপন
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২৩:১০
ঢাকা: গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সহসম্পাদক রুপন ভূইয়ার ক্যাসিনোর টাকার সন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুই ভাইয়ের বিলাসী জীবনযাপনের তথ্য। র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রের হুমকি দিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাড়ি লিখে নেওয়া থেকে শুরু করে পদ-পদবীও বাগিয়ে নিতেন এই দুই ভাই। আর কোটি কোটি টাকা ও ঢাকা শহরে প্রায় ৫০টি ফ্ল্যাটের মালিক এই দুই ভাই কখনোই কোনো পেশায় যুক্ত ছিলেন না। ক্যাসিনোই তাদের টাকা-পয়সার একমাত্র উৎস।
র্যাব-৩-এর কমান্ডিং অফিসার(সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম শফিউল্লাহ বলেন, র্যাব এখন পর্যন্ত এনু ও রুপনের ১৫টি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে। তবে ক্যাসিনোর টাকা দিয়ে তারা গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ৫০টির মতো বাড়ি কিনেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
র্যাব এনু-রুপনের যে ১৫টি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে, তারই একটি সুত্রাপুরের বানিয়া নগরের ৩১ নম্বর বাড়ি। এই বাড়িতে এনু-রুপন কেউ থাকেন না। ছয় তলা ভবনটিতে থাকেন তাদের আত্মীয়-স্বজনরা। এই ভবনের দ্বিতীয় ও পঞ্চম তলায় এনামুল হক এনুর শ্যালক ও শাশুড়ি থাকেন। এই বাড়িরই দ্বিতীয় একটি ও তৃতীয় তলায় দুইটি ভল্ট পাওয়া গেছে। এই দুই ফ্ল্যাটেই পাওয়া যায় ৭৩০ ভরি সোনা।
র্যাব সিও জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন, রাজধানীর ইংলিশ রোড থেকে পাঁচটি ভল্ট কে বা কারা ভাড়া নেয়। সেই ভল্টের খোঁজ করতে গিয়েই পাওয়া যায় রুপন ও এনামুলের নাম। অনুসন্ধানে র্যাব জানতে পারে, ক্যাসিনোর লাভের টাকা এসব ভল্টে রাখা হয়েছে। নগদ টাকা রাখতে অনেক ভল্ট লাগতে পারে বলে তারা সোনা কিনে রাখছেন বলে ধারণা করা হয়।
আরও পড়ুন- ক্যাসিনো ব্যবসা: গেন্ডারিয়া থানা আ.লীগের ২ নেতার খোঁজে র্যাব
র্যাবের সেই তথ্য অনুযায়ী অভিযান চালিয়েই বানিয়া নগরে পাওয়া যায় তিনটি ভল্ট। বাকি দু’টি ভল্ট উদ্ধারে অভিযান চালানো হয় নারিন্দার লালমোহন দাস লেনের ৮৩/১ নম্বর বাসায়। সেখানে আবুল কালাম, ওরফে কালার বাসায় একটি ভল্ট পাওয়া যায়। সেখান থেকে দুই কোটি টাকা, একটি অবৈধ অস্ত্র ও ১৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। স্থানীয়রা জানান, কালা দীর্ঘদিন ধরে ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে লেদের দোকান করতেন। সেখান থেকে হঠাৎ করে দোকান বাদ দিয়ে মতিঝিলের কোথায় যেন চাকরি নেন।
র্যাব জানায়, এনু ও রুপনের কর্মচারী এই কালা। বিশ্বস্ত কর্মচারী হওয়ায় কালার বাসায় রাখা হয় একটি ভল্ট। অভিযানের সময় কালাকে বাসায় পাওয়া না গেলেও তার স্ত্রী ও সন্তানরা বলেন, চার দিন হলো ভল্টটি এখানে রেখে গেছেন এনু ও রুপন। তারা বলেছেন, ভল্টটি এখানে কয়েকদিনের জন্য রাখতে হবে। পরে তারা এসে আবার ভল্টটি নিয়ে যাবেন। ভল্টের ভেতরে কী আছে, তা জানতেন না বলে জানান কালার স্ত্রী ও সন্তানেরা।
আরও পড়ুন- এনামুল-রুপনের পাঁচ ভল্টে কোটি টাকা উদ্ধার, আরও ১৫ বাড়ির খোঁজ
এরপর র্যাব অভিযান চালায় নারিন্দার শরৎ গুপ্ত রোডের ২২/১ বাসায়। সেখানে দুই তলায় একটি ভল্টের ভেতর থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। এই বাসাটি এনুর বন্ধু হারুন অর রশীদের। রশীদ ওয়ারী আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বলে জানা গেছে। রশীদ বাসায় না থাকলেও তার স্ত্রী বলেন, তিন-চার দিন আগে এনু এই টাকার ভল্টটি এনে রেখে যান। এখানেও তিনি বলে যান, কয়েকদিন এই ভল্টটি রাখতে হবে। কয়েকদিন পর এসে নিয়ে যাবেন।
লাল মোহনদাস লেনের পাশেই খোঁজ মেলে বিলাসবহুল ১০ তলা এক ভবনের। জানা যায়, মমতাজ ভিলা নামে ১০৬ নম্বর এই বাসাটি এনু ও রুপন মিলে নির্মাণ করেছেন। ১০ তলা এই ভবনটি আধুনিক ও অভিজাত নকশায় নির্মিত। ভবনটির প্রতিটি স্থানে দৃষ্টিনন্দন সব কারুকাজ করা হয়েছে। ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে থেকে কলাপসিবল গেটে তালা লাগানো রয়েছে। তবে ভবনে প্রবেশ করতে হলে সরু অনেকগুলো গলি পার হতে হয়। গলিগুলো এমন যে প্রথমবার কেউ প্রবেশ করার পর বের হতে চাইলে রাস্তা ভুল করাটাই স্বাভাবিক।
সেকেন্দার আলী নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা সারাবাংলাকে বলেন, ১০ তলা ভবনটির পুরোটাই ব্যবহার করছেন দুই ভাই এনু ও রুপন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় দুই ভাই রাজকীয়ভাবে থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো কাউকে ভাড়া দেওয়া হয় না। এর মধ্যে কয়েকটি ফ্ল্যাটে থাকেন এনু-রুপনের আত্মীয়-স্বজনরা। তারা মূলত দুই ভাইয়ের সহযোগী হিসেবেই কাজ করেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন অফিস হিসেবে। এছাড়া রয়েছে নাচ-গানের একটি স্টুডিও। মিটিংয়ের জন্য রয়েছে আলাদা ফ্ল্যাট।
সেকেন্দার জানান, এই ভবনে বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। তবে এনু-রুপনের কোনো একটি কাজের সূত্র ধরে সেকেন্দার একবার প্রবেশ করেছিলেন এই ভবনে।
সুবাস নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, এই ভবনের ভেতরে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা আসেন। অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাও আসেন। র্যাব সদস্যরা সোমবার ভোরে এই বাসায় অভিযান চালিয়েছে। অভিযানের পর বাইরে থেকে তালা লাগানো হয়েছে। অভিযানে রুপনসহ কয়েকজনকে র্যাব নিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছেন স্থানীয় এই বাসিন্দা।
র্যাব ও স্থানীয়রা জানিয়েছে, এরকম বিলাসবহুল বাড়ি ঢাকা শহরে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে, যা অনেকেই জানত না। তারা কোনো ধরনের ব্যবসা করেন না। তাদের অন্য কোনো পেশা নেই। তাহলে কী করে এত বাড়ি কিনতে পারে একজন ব্যক্তি— সেটাই এখন মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, এনামুল ও রুপনেরা ছয় ভাই। ১৯৮৫ সাল থেকেই এনামুল ওয়ান্ডার্স ক্লাব ও রুপন আরামবাগ ক্লাবে জুয়া খেলত। একটা সময় তারা জুয়ার বোর্ডের মালিক বনে যান। সেখান থেকে আসতে থাকে কাঁচা টাকা। সেই টাকাতেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ফ্ল্যাট ও বাড়ি কিনেছেন এনু-রুপন। বানিয়া নগরের বাড়িটি গত দেড় বছর আগে হারুনুর রশীদ নামে একজনের কাছ থেকে তারা কিনেছেন।
জুয়ার বোর্ড থেকে যে টাকা আসত, সেই টাকার একটি অংশ এনু ও রুপন বাসাতেই রাখতেন। র্যাবের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে তারা নগদ টাকায় সোনা কিনে ভল্ট ভাড়া করে রাখতে শুরু করেন। আরও কোথায় কোথায় তারা টাকা বা সোনা রেখেছেন, তা জানতে অনুসন্ধান চলছে বলে জানান র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা।
আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ক্যাসিনোর টাকা জুয়ার বোর্ড বিলাসী জীবনযাপন ভল্টে টাকা ভল্টে সোনা রুপন ভূইয়া