রেজিস্ট্রি অফিসের সহকারী কোটিপতি, ৫ ফ্ল্যাটের মালিক
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:২১
ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের প্রধান সহকারী কাজল কুমার চন্দের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাকরির ১৫ বছর একই কর্মস্থলে থেকে ময়মনসিংহ শহরে পাঁচটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকানের মালিক হয়েছেন তিনি। পাঁচ ফ্ল্যাটের মধ্যে দুইটি ও দোকান অবশ্য রয়েছে তার ভাইয়ের নামে। কাজল নিজে বলছেন, তিনি দুইটি ফ্ল্যাটের মালিক। জেলা রেজিস্ট্রার বলছেন, কাজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে।
ময়মনসিংহ রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন নকলনবিশ অস্থায়ীভাবে যোগ দেওয়ার ১০ থেকে ১৫ বছর পর তাদের চাকরি স্থায়ী করতে রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ দিতে হয় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। কাজল কুমার চন্দের মাধ্যমে সেই টাকা লেনদেন হয়। এই লেনদেনের বড় একটি অংশ পান কাজল। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে মাসোহারা, বদলির তদবির ও বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্যও করেন তিনি। আর এসব উৎস থেকে আসা টাকায় কোটিপতির তকমা বাগিয়েছেন কাজল।
জানা গেছে, জেলা রেজিস্ট্রি অফিসে নিম্নমান সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কাজল কুমার চন্দ। সাত-আট বছর চাকরির পর তিনি উচ্চমান সহকারী হিসেবে পদোন্নতি পান। নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতির পর তার বদলি হওয়ার কথা থাকলেও আরও সাত-আট বছর তিনি একই অফিসে কাজ করে যাচ্ছেন। এখনো তিনি তার প্রথম কর্মস্থলেই প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
কাজল কুমার চন্দের ‘আয়ের উৎস’ সম্পর্কে ময়মনসিংহ নকল-নবিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, ‘আমাদের অফিসে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ জন নকল তোলার আবেদন করেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এর খরচ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা হলেও একেকজনের কাছ থেকে নেওয়া হয় একহাজার থেকে ১২শ টাকা। অতিরিক্ত টাকা প্রতিদিন রেকর্ড কিপারের মাধ্যমে কাজল কুমার চন্দের পকেটে যায়।’
এছাড়াও কাজলকে ‘ম্যানেজ’ করে জেলার ফুলবাড়িয়াসহ বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ষাটোর্ধ্ব ১০-১৫ জন নকলনবিশ নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নকল তুলতে আসা চর-ঈশ্বরদিয়ার এনামুল হক জানান, একটি জমির নকল তুলতে কাজল বাবুর কাছে পরামর্শের জন্য যাই। পরে কাজল বাবু আমার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নেন। কিন্তু আমি টাকা দিয়েও চার মাস ধরে নকলের জন্য ঘুরছি।
কাজল তার চারটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান কিনেছেন নগরীর দুর্গাবাড়ি রোডের আবাসন খাতের ব্যবসায়ী রাইট পয়েন্টের মালিক হোসেন ফকিরের কাছ থেকে। তিনি সারাবাংলাকে জানান, জেলার সহকারী রেজিস্ট্রার কাজল কুমার চন্দ আমার কাছ থেকে চারটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান কিনেছেন। ফ্ল্যাটগুলো ৯৩০ স্কয়ার ফিট আয়তনের। সব মিলিয়ে এগুলোর দাম পড়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
ময়মনসিংহ নকল-নবিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক সোহেল আকন্দ বলেন, ‘সহকারি রেজিস্ট্রার একই কর্মস্থলে ১৫ বছরে ধরে রয়েছেন। শহরে তার নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। শহরের রাইট পয়েন্ট টাওয়ারে পাঁচ তলা ও ১১ তলায় রয়েছে দুইটি করে ফ্ল্যাট। নিচতলায় রয়েছে একটি দোকান। এছাড়া আঠারবাড়িতে তার নিজের ফ্ল্যাট নির্মাণাধীন।’ তবে ফ্ল্যাটগুলোর মধ্যে দুইটি তার নিজের নামে রয়েছে, বাকি দুইটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান রয়েছে ভাই বিপ্লব কুমার চন্দের নামে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কাজল কুমার চন্দ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষ ১৫ বছর সরকারি চাকরি করলে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়। আমি তো মাত্র দুইটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছি, বেশি কিছু করিনি। বাকি ফ্ল্যাটগুলো আমাদের পরিবারের কেনা।’
কাজলের ভাই স্থানীয় একটি স্কুলের হিন্দু ধর্মের শিক্ষক বিপ্লব কুমার চন্দ বলেন, ‘আমি হাই স্কুলের শিক্ষক, আমার স্ত্রী গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি করে। আমাদের অবস্থা খারাপ নয়। শহরে আমাদের পাঁচটি ফ্ল্যাট বাসা ও দোকান রয়েছে। মূলত সবক’টি ফ্ল্যাটের মালিক কাজল ভাই, তবে দু’টি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান আমার নামে রেজিস্ট্রি করিয়েছেন।’
কাজল ও বিপ্লব নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতার এমন দাবি করলেও তার সঙ্গে একমত নন স্থানীয়রা। কেন্দুয়া উপজেলার জল্লী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হক বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের হিন্দু ধর্মের শিক্ষক বিপ্লব কুমার চন্দ। তাদের অবস্থা মোটামুটি ভালো। তবে তাদের বাড়িতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা বিক্রি করেও ময়মনসিংহ শহরে পাঁচটি ফ্ল্যাট বাসা ও একটি দোকানের মালিক হওয়া সম্ভব নয়। তবে শুনেছি তার ভাই কাজল অনেক টাকা ইনকাম করেন।’
একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ১০ হাজার ২শ টাকা স্কেলে চাকরি করে কিভাবে পাঁচটি ফ্ল্যাট ও দোকানের মালিক হয়, সেটি বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন জেলা জনউদ্যোগের আহ্বায়ক ও ময়মনসিংহ জেলা মানবাধিকার কমিশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু। তিনি বলেন, দ্রুত এদের চরিত্র জনসম্মুখে উন্মোচন করে অবৈধ অর্থ দিয়ে উপার্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। পাশাপাশি তার অনৈতিক কাজে সহযোগীদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা রেজিস্ট্রার সরকার লুৎফুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আসার আগে রেজিস্ট্রি অফিসে কী হয়েছে, জানি না। তবে এখন রেজিস্ট্রি অফিসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখানে অনিয়ম করার সুযোগ নেই। তবে কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখা হবে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ফারুক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, জেলার প্রতিটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।