গ্রাম আদালতকে আরও কার্যকরের পক্ষে বললেন সাংবাদিকরা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:১২
ঢাকা: বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার ভ্যান চালক একরামুল ইসলাম। তার রোজগারেই চলে সংসার। দীর্ঘদিনের সঞ্চয় থেকে তিন শতাংশ জমি কিনতে ২২ হাজার টাকার বায়না দেন জমির মালিককে। কিন্তু বায়নার টাকা হাতে পেয়েই লাপাত্তা হয়ে যান বিক্রেতা। প্রতারণার শিকার একরাম তখন প্রচলিত আইনে মামলা করতে চান। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটি জটিল ও ব্যয়বহুল হওয়ার দরিদ্র একরাম বিচার চান গ্রাম আদালতে। এরপর অল্প কয়েকদিনের শুনানি শেষে মাত্র ১০ টাকা খরচে ওই মামলায় জেতেন তিনি। গ্রাম আদালতের বিচারকদের রায়ে তিনি ফেরত পান তার বায়না ও ক্ষতিপূরণ মিলিয়ে মোট ২৮ হাজার পাঁচশ টাকা।
একরামুলের মতো অনেকেই এখন বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকার পাচ্ছেন গ্রাম আদালতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হতদরিদ্র মানুষদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচারে মামলা জট, হয়রানি আর ব্যয় থেকে বাঁচাতে গ্রাম আদালতকে একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গ্রাম আদালত নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এ বিষয়ে একমত হন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া সাংবাদিকরাও।
মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ, অনেকাংশে দরিদ্রও বটে। একইসঙ্গে এই দেশে রয়েছে বিভিন্ন রকমের আইনি সমস্যা। যেসব সমস্যা আগে থেকেই জট পাকিয়ে রয়েছে, সেগুলো রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে সমাধান করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ছোট আইনি সমস্যাগুলো সমাধান করতে গ্রাম আদালত তাই দারুণ একটি উদ্যোগ। এটি আগে এটি অনানুষ্ঠানিকভাবে চালু ছিল, এখন আমরা একে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে চাচ্ছি।’
মন্ত্রী বলেন, ‘গ্রাম আদালতকে জনপ্রিয় করতে হলে সাংবাদিকদের ব্যাপকভাবে যুক্ত করতে হবে। গ্রাম আদালত কিভাবে কাজ করে, এখানে বিচার প্রক্রিয়ায় মানুষ কতটা উপকৃত হচ্ছে কিংবা ন্যায় বিচার কতটুকু পাচ্ছে— সেসব নিয়ে লিখবেন। গ্রাম আদালতকে কিভাবে আরও বেশি কার্যকর করা যায়, সে বিষয়ে আইডিয়া দেবেন।’
বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত রেনসে তিরিঙ্ক বলেন, ‘ন্যায় বিচার পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে গ্রাম আদালতের একটি ভালো দিক হলো এখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে গ্রাম আদালতে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে এবং অবশ্যই সব পক্ষের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দিয়ে বিচার কাজ পরিচালনা করতে হবে।’
প্রচলিত আইনে বাংলাদেশের আদালতগুলোতে চল্লিশ লাখেরও বেশি মামলা আটকে আছে উল্লেখ করে ইউএনডিপি’র আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জী বলেন, ‘মামলা জটের কারণে বিচার কাজ নিয়ে মানুষ অসন্তুষ্ট। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর যখন মামলা নিষ্পত্তি হয়, তখন কোনো পক্ষই খুশি হতে পারে না। এখান থেকে আবার নতুন দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। ফলে এটা কখনো কাম্য হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘পৃথিবী ধীরে ধীরে দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠছে। প্রায় প্রতিটি দেশ কোনো না কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এই দ্বন্দ্ব যেন দেশের ভেতরের মানুষের মধ্যে না থাকে, এজন্য অবশ্যই সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাম আদালতকেও সেভাবেই পরিচালনা করতে হবে। ভারতের গ্রামপঞ্চায়েতের মতো অবিচারের চর্চা করলে হবে না।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আগে মামলার খরচ চালাতে গিয়ে দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হতো। ছোট মামলাগুলো সাজাতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের মিথ্যার আশ্রয়ও নিতে হতো। গ্রাম আদালতে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এটি সাশ্রয়ী, আর তাছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে বিচার পরিচালিত হওয়ার মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার সম্ভাবনা কম।’
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সারাবাংলা ডটনেট ও গাজী টিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন এটিকে সক্রিয় করতে হবে। বাংলাদেশে কয়েক লাখ মামলা বিচারাধীন। অনেকে আছেন যারা বিচার পাচ্ছেন না। এসব প্রান্তিক মানুষদের বিচার পাইয়ে দিতেই গ্রাম আদালতকে সচল করতে হবে। এর মাধ্যমে মামলা জট যেমন কমবে, তেমনি হয়রানিও কমবে।’
বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের বার্তা সম্পাদক প্রভাষ আমিন বলেন, ‘ভোটের কথা বিবেচনা করে গ্রাম আদালতে যেন প্রভাবশালীদের বাঁচিয়ে দেওয়া না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটি করা হলে এই প্রকল্পটি সাধারণ মানুষের আস্থা হারাবে।’
সারাবাংলা ডটনেটের নির্বাহী সম্পাদক মাহমুদ মেনন খান বলেন, ‘গ্রাম আদালতে বড় অপরাধ সাধারণত আসে না। কিন্তু মিডিয়ার চোখ থাকে বড় অপরাধের দিকে। ফলে এর খবর প্রচার হয় সাধারণ ঘটনা বর্ণনার মতো করে। সাংবাদিকদেরকে এখানে সচেতন হতে হবে। গ্রাম আদালতে নাটক-সিনেমার মতো কিছু গল্প থাকে। যারা মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিক, তাদের দায়িত্ব নিয়ে বিষয়টি তুলে আনতে হবে। রায়ের বর্ণনা না লিখে ভেতরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে হবে।’
আয়োজকরা জানান, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে গ্রাম আদালত আইন পাস করা হয়। পরে ২০১৩ সালে আইনটিতে কিছু সংশোধন এনে ইউনিয়ন পরিষদে ছোটখাট মামলার নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘অ্যাকটিভ ভিলেজ কোর্টস ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি পাইলট প্রকল্প ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়ন করে। এ পাইলট প্রকল্পটি দেশের ১৪ জেলার ৫৭টি উপজেলায় ৩৫১টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হয়।
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেখানে সারাদেশে ২৭টি জেলার ১২৮ উপজেলার একহাজার ৮০টি ইউনিয়নে বিচার কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ২৬টি উপজেলার ১২১টি ইউনিয়নে প্রকল্পটি সম্প্রসারিত করা হয়।
গ্রাম আদালত মামলা মামলা জট স্থানীয় সরকার বিভাগ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়