ইরান ইস্যুতে কেন মধ্যস্থতা চান সৌদি যুবরাজ ও ট্রাম্প?
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২২:৫৯
বেশ কিছুদিন ধরেই ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে সৌদি আরব এবং আমেরিকার সামরিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলে আসছিল। সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনায় ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ আন্দোলন সমর্থিত সেনাদের ড্রোন হামলার পর সেই উত্তেজনায় কার্যত ঘি ঢালা হয়েছে। আরামকো হামলার পর বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক ভেবেছিলেন যে, ইরানের সাথে আমেরিকা ও সৌদি আরবের যুদ্ধ আসন্ন। কিন্তু সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং ঘটনা ঘটেছে উল্টো। যুদ্ধের পরিবর্তে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন ইরানের সঙ্গে একটা মধ্যস্থতায় আসতে চাচ্ছেন। আর এ বিষয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মাধ্যমে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। বিষয়টি প্রস্তাব আকারে গেলেও পর্দার আড়ালে তা অনেকটা অনুরোধের সুরেই ঘটেছে বলে অনুমান করা যায়। এদিকে ইমরান খান এরই মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট রুহানির সঙ্গে ইমরান খানের কী কথা হয়েছে এবং মধ্যস্থতার বিষয়ে তিনি কতদূর এগিয়ে যেতে পারবেন তা জানা যায়নি। তবে বর্তমানে বিশ্বের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- কেন সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলেন?
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায় যে, আরামকোর ওপর হুথিদের ড্রোন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ বদলে গেছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ইয়েমেনের হুথি ও ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এদিকে আরামকো হামলার পর সৌদি আরবের দৈনন্দিন তেল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। সৌদি আরব প্রতিদিন আরামকোর আবকাইক তেলক্ষেত্র থেকে ৭০ লাখ ব্যারেল আর খুরাইশ তেলক্ষেত্র থেকে ১৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করত। হামলার পর দুটি ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ৮৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। শুধু তাই নয়, আরামকোর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে এই তেলক্ষেত্র কবে স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরবে সে নিশ্চয়তাও দিতে পারছে না সৌদি সরকার। সিএনবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক হ্যাডলি গ্যাম্বেল ২১ সেপ্টেম্বর আরামকো থেকে যে রিপোর্ট করেছেন তাতে দেখা গেছে, সেখানে রাতদিন মেরামতের কাজ চলছে এবং সৌদি কর্তৃপক্ষের দাবি, সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ তারা পুরোপুরি উৎপাদনে ফিরতে পারবে। তবে হ্যাডলি গ্যাম্বেল জানিয়েছেন, আরামকো মেরামতের জন্য আমেরিকা ও ব্রিটেন থেকে অনেক যন্ত্রপাতি আনতে হবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে খুব সহজেই এ কাজ শেষ হবে না।
এদিকে ইয়েমেনের হুথি আন্দোলনের প্রধান আব্দুল মালেক আল-হুথি কয়েকদিন আগে হুমকি দিয়েছেন যে, সৌদি আরব যদি যুদ্ধ বন্ধ না করে তাহলে আরামকোর ওপর আবারও হামলা চালানো হবে। এখন আর এ কথা বলতে কারও বলতে দ্বিধা নেই যে, আরামকোর ওপর হামলার পর সৌদি আরব বড় ধরনের বিপদে পড়েছে। শুধু সৌদি আরব নয়, আমেরিকাও মারাত্মকভাবে চাপের মুখে রয়েছে। আরামকো তেল স্থাপনায় হামলার পর আন্তর্জাতিক বাজারে যেমন তেলের সরবরাহ কমেছে, তেমনি জ্বালানি তেলের দামও বেড়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে আমেরিকাকে। এরপরই রয়েছে সৌদি আরব। এ অবস্থায় ফের যদি হুথিরা হামলা চালায় এবং সৌদি আরবের তেলের উৎপাদন একেবারে শূন্যে নেমে আসে তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। যেখানে আমেরিকা এবং সৌদি আরব মিলে ইরানের তেল উৎপাদন শূন্যের কোঠায় আনতে চেয়েছিল সেখানে সৌদি আরবের পরিস্থিতিই এখন ত্রিশঙ্কু। এ অবস্থায় ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের আপস-আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
সৌদি আরব, ইসরাইল এবং আমেরিকা-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা মিত্ররা বলে আসছে- সৌদি আরবের সঙ্গে যে যুদ্ধ চলছে তাতে ইয়েমেনের হুথিদেরকে সমর্থন দিচ্ছে ইরান। বিষয়টি যদি তাই হয় সেক্ষেত্রে হুথিদের সঙ্গে এখন সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় না গেলেও ইরানের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া তাদের কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু তারা সে আলোচনা সরাসরি করতে পারছে না। এজন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মাধ্যমে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আরামকো হামলার পর কয়েকটি বিষয় সৌদি আরবের সামনে একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। যেমন: সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানের সামনে বিষয়গুলো খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যে বিষয়টি সবচেয়ে আগে পরিষ্কার হয়েছে সেটি হচ্ছে- আরামকোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখার পরও মার্কিন সামরিক প্রতিরক্ষা ও রাডার ব্যবস্থা সেটিকে রক্ষা করতে পারেনি। সেক্ষেত্রে এখন যদি হুথিরা আবারও হামলা চালায় তবে তা ঠেকানোর মত অবস্থা সৌদি আরবের নেই। আর এমন হলে সৌদি আরবের তেল উৎপাদন একেবারে জিরো পজিশনে নেমে আসবে। ফলে এই মুহূর্তে সৌদি যুবরাজের সামনে আলোচনা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
আরামকো স্থাপনায় হামলার পর সৌদি যুবরাজের সামনে আরও যে বিষয়টি খুব পরিষ্কার হয়েছে সেটি হচ্ছে- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই তাদেরকে সমর্থন দিক; যতই বলুক ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব; ইরানকে মানচিত্র থেকে মুছে দেব; তাদেরকে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে একেবারে নিঃস্ব করে দেব- এর কোনোটিই ডোনাল্ড ট্রাম্প করতে পারেনি, এমনকি পারবেও না। পারস্য উপসাগরে ব্রিটিশ তেলবাহী জাহাজ আটক করেছে ইরান; ওমান সাগরে কয়েকটি জাহাজে সন্দেহভাজনরা হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে সৌদি আরবের সামনে আশানুরূপ কোনো কিছু তুলে ধরতে পারেনি আমেরিকা। এসব ঘটনা থেকে আমেরিকাকে সম্ভবত সৌদি যুবরাজ কাগুজে বাঘ বলেই চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
তৃতীয় যে বিষয়টি সৌদি যুবরাজের কাছে স্পষ্ট হয়েছে তা হলো- ইয়েমেনে আগ্রাসন চালানোর পর সাড়ে চার বছর চলে গেলেও সৌদি আরব দেশটিতে যেসব লক্ষ্য নিয়ে হামলা চালিয়েছিল তার একটিও অর্জন করতে পারেনি। উপরন্তু যুদ্ধে বহু সংখ্যক সৌদি সেনা নিহত হয়েছে, প্রচুর পরিমাণে সামরিক ক্ষতি হয়েছে এবং আরামকোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হুথিদের হামলায় তেলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ ইয়েমেনে আগ্রাসন চালানোর পরপরই সৌদি যুবরাজ ৩৪ জাতির কথিত ইসলামিক সামরিক জোট গঠন করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের জরুরিভিত্তিতে তলব করেছিলেন। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো- সেই জোট গঠন করা যায়নি। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বিদেশ সফরে সৌদি আরবে গিয়ে ৫১ জাতির আন্তর্জাতিক সামিরক জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও তা গঠন করা সম্ভব হয়নি। ওমান সাগরে অবস্থিত কয়েকটি তেলবাহী জাহাজে সন্দেহভাজনরা হামলার পর আমেরিকা ওই আন্তর্জাতিক সামরিক জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু জোট গঠন না করে পারস্য উপসাগরে জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের নামে আমেরিকা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত টহল দিচ্ছে। এই জোট গঠনের ক্ষেত্রে আমেরিকার ব্যর্থতাও সৌদি যুবরাজের সামনে ধরা না পড়ার কোনো কারণ নেই।
সৌদি যুবরাজ আঞ্চলিক মিত্রদেরকে নিয়ে অনেক বড় কিছু করবেন বলে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন এখনও স্বপ্নই রয়ে গেছে; তার কোনকিছুই বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। বরং সেই স্বপ্ন ক্ষেত্রবিশেষে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। যেমন: সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান ক্ষমতাধর হওয়ার পর উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি থেকে কাতারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ বের হয়ে গেছে এবং তাদের সঙ্গে এখন সৌদি আরবের দা-কুমড়ার সম্পর্ক। ইয়েমেনে আগ্রাসন চালানোর সময় কাতার তাদের সঙ্গে থাকলেও এখন আর নেই। শুধু তাই নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ইয়েমেন ইস্যুতে অনেকটা পিছুটান দিয়েছে। তারা এরই মধ্যে ইয়েমেন থেকে অনেক সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বন্দ্ব এখন ওপেন-সিক্রেট ব্যাপার। এছাড়া ওমান ও কুয়েতের মতো দেশকে সৌদি আরব এখন কোনো প্রয়োজনেই আর কাছে পাচ্ছে না। ওমান-কুয়েত এখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নিরপেক্ষ অবস্থানে। অন্যদিকে ইয়েমেন আগ্রাসনে অংশ নেওয়া মিশরের স্বৈরশাসক জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দেশে এখন প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে। তার ক্ষমতা কতদিন স্থায়ী হবে তা নিয়েও রীতিমতো প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে খুবই গ্যাঁড়াকলে পড়েছে। ফলে দেশটির সামনে ইরানের সঙ্গে আলোচনা ও আপস ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পও কেন আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন?’- সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা এখনও নিজেদের বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি মনে করে। এমনকি কর্মক্ষেত্রে বেশিরভাগ দেশ বিষয়টি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নেয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন ইরানের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মাধ্যমে প্রস্তাব দেন তখন এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- কেন তিনি এমনটি চাইছেন?ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেও তার বড় একটি পরিচয় হচ্ছে- তিনি একজন ধনকুবের ব্যবসায়ী। তার মননে-মগজে ব্যবসা এবং ডলার ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। যুদ্ধ করে অর্থ খরচ করা তার কাছে যেমন অপচয় ছাড়া কিছু নয়, তেমনি সৌদি আরবের মতো কিছু দেশকে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে তাদের কাছে চড়ামূল্যে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করতে পারাটাই ট্রাম্পের অনেক বড় সফলতা। ফলে সৌদি যুবরাজ যখন ইমরান খানের মাধ্যমে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটা মেনে নিয়ে তরুণ যুবরাজকে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলেই মনে হয়।
এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় আছে। যেমন- হুথিরা যদি নতুন করে হামলা চালায় আর সৌদি আরবের তেলের উৎপাদন কোনো কারণে যদি শূন্যের কোঠায় নেমে আসে তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কোথায় গিয়ে পৌঁছবে? এছাড়া আমেরিকার ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কী হবে তা কল্পনা করা মুশকিল। ব্যবসায়ী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। পরিস্থিতি যদি এমন হয় তাহলে তেলসমৃদ্ধ রাশিয়া ভীষণভাবে লাভবান হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে কোনো বিকল্পও থাকবে না। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে তাকে। এর কারণ হচ্ছে, তিনি ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছেন এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ইয়েমেনের যে যুদ্ধ তাতে মার্কিন সমর্থন দিয়েছেন। যুদ্ধে মার্কিন মদদ যেহেতু জারি রয়েছে সে কারণে যুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে না। এজন্য হুথিরা যদি আরামকোয় নতুন করে হামলা চালায় এবং সৌদি আরবের তেল উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এর দায়-দায়িত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না। ফলে সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ট্রাম্প নিজেও ইমরান খানকে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
আরামকো তেল স্থাপনার ওপর হামলার পর সৌদি আরবের আগেই আমেরিকা অভিযোগ করেছে যে, ইরান এ হামলা চালিয়েছে অথবা তারা এর সঙ্গে জড়িত। আমেরিকার এই অভিযোগের মুখে রাশিয়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, আরামকো হামলার ব্যাপারে চটজলদি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না। অর্থাৎ আমেরিকা যে অভিযোগ করছে সেই অভিযোগের সঙ্গে রাশিয়া একমত নয়। ইরানের আরেক প্রতিবেশী এবং মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানও হামলার ব্যাপারে ইরানকে দায়ী করতে রাজি হননি। তিনি গত সপ্তাহে মার্কিন গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইরানকে দায়ী করার জন্য আমেরিকা ও সৌদি আরব যে সমস্ত প্রমাণ তুলে ধরছে তা যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ মিত্রদের কারও কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তেমন কোনো সমর্থন পাননি। সে ক্ষেত্রে তিনি ইরানের সঙ্গে এক ধরনের আপস-আলোচনার জন্য ইমরান খানের মাধ্যমে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে থাকতে পারেন।
ট্রাম্পের আশা ছিল- জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি আমেরিকা সফর করবেন এবং ট্রাম্প তার সঙ্গে বৈঠক করবেন। কিন্তু তিনি যখন নানা চ্যানেল থেকে বার্তা পান যে, ইরানের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন না তখন তিনি অনেকটা উপায়হীন হয়ে ইমরান খানকে ধরেন। কারণ ইমরান খান হচ্ছেন ইরানের নিকটতম প্রতিবেশী এবং তিনি এই মুহূর্তে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। পাশাপাশি সৌদি আরবের সঙ্গে ইয়েমেনের এবং ইরানের যে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব সেই দ্বন্দ্বে পূর্বসূরী নওয়াজ শরীফের মতো ইমরান খানও সরাসরি সৌদি আরবের পক্ষ না নিয়ে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছেন। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তেমনি রয়েছে ইরানেরও। পাশাপাশি পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ শিয়া সম্প্রদায়ের; যা দেশটির কোনো শাসক একেবারে উপেক্ষা করতে পারেন না। ফলে ইমরান খানকে যোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকতে পারেন সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে আরও একটি বিষয়টি আনতে হচ্ছে। সেটি হচ্ছে- আরামকো তেল স্থাপনার ওপর হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরাইলও ভীত হয়ে পড়েছে। দেশটির ভীত হয়ে পড়ার কারণ এই ভেবে যে, এ ধরনের হামলা যদি তাদের ওপর হয় তাহলে তা ঠেকানোর মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। এদিকে ইয়েমেনের হুথিরা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে, তাদের কাছে এক হাজার ৭০০ কিলোমিটার পাল্লার ড্রোন রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রও। ইসরাইলের প্রধান শত্রু ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাস তো থাকলোই। এছাড়া দেশটির সাম্প্রতিক নির্বাচনে যুদ্ধবাজ নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পরাজিত হয়েছেন। সেখানে সাবেক জেনারেল বেনি গান্তজের সঙ্গে আরব জোট যোগ দিয়ে সরকার গঠন করবে। সেক্ষেত্রে সম্ভবত ইসরাইলের রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর ভূমিকা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দেশটির এই নিরাপত্তাহীনতাকেও বিবেচনায় নিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে সামগ্রিক আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার হয় যে, আমেরিকা এবং সৌদি আরবের সামনে এখন যুদ্ধের কোনো পথ খোলা নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পও ওই পথে হাঁটবেন না। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে সামনে রেখে সৌদি যুবরাজ ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর যে অলীক কল্পনা করে আসছিলেন তা থেকে তিনিও এখন সরে এসেছেন। আরামকো হামলা তাকে সম্ভবত বাস্তবতা অনুধাবন করতে সাহায্য করেছে।
লেখক: রেডিও তেহরানের সাংবাদিক
আরামকো ইরান ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব সৌদি যুবরাজ সালমান