পশ্চিমাঞ্চলে একের পর এক নতুন ট্রেন, অবহেলিত পূর্বাঞ্চল
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:৪২
ঢাকা: ২০১৯ সালের এপ্রিলে ঢাকা-রাজশাহী রুটে চালু হয়েছে নতুন ট্রেন বনলতা এক্সপ্রেস। ঠিক এর পরের মাসে চালু হয় পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। ঢাকা-বেনাপোল রুটে গত জুলাইয়ে চালু হয়েছে বেনাপোল এক্সপ্রেস। আর অক্টোবরে রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেসে সংযোজন হচ্ছে নতুন কোচ। এই রুটে আরেকটি ট্রেন চালুরও কথা রয়েছে। এভাবেই রেলের পশ্চিমাঞ্চলে একের পর এক নতুন ট্রেন ও কোচ সংযোজন হলেও অবহেলিত থেকে যাচ্ছে পূর্বাঞ্চল।
বাংলাদেশ রেলওয়েকে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল- এই দুইভাগে ভাগ করা হয়। সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে টানা নতুন ট্রেন ও কোচ যাচ্ছে পশ্চিমাঞ্চলে। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ওই অঞ্চলের এমপি। সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে- রেলমন্ত্রীর বাড়ির আশেপাশেই নতুন সব ট্রেনের গন্তব্য!ওই অঞ্চল থেকে আসা দাবির প্রতি তিনি দুর্বল- এমন অভিযোগও রয়েছে।
এদিকে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে দীর্ঘদিন ধরে নতুন ট্রেন নেই বললেই চলে। যাত্রীসেবা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ গেছে খোদ মন্ত্রণালয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পূর্বাঞ্চলের ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুট। এই দুই রুটে ট্রেনগুলোর বেহাল দশা। এদিকে ওই অঞ্চলগুলোতে সড়কপথে বেসরকারিভাবে একের পর এক বিলাসবহুল বাস যুক্ত হলেও নতুন ট্রেন চালুর ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় উদাসীন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সূত্র জানায়, ঢাকা-সিলেট রুটে গত তিন বছরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাস সংখ্যা বেড়েছে। চালু হয়েছে এনা পরিবহনের হুন্দাই বাস। এছাড়া যুক্ত হয়েছে গ্রিন লাইন ও লন্ডন এক্সপ্রেসের হাইডেক এসি বাস।
একই সময়ে সিলেট রুটের ট্রেন থেকে এসি কোচ খুলে নেওয়ার ঘটনাও দেখা গেছে। এদিকে ঢাকা-সিলেট রুটে এক সময়ের জনপ্রিয় কালনী এক্সপ্রেস প্রথম শ্রেণির আন্তঃনগর হলেও এখন লোকাল ট্রেনের চেয়েও নিম্নমানের সেবা দিচ্ছে। মাত্র সাতটি কোচ দিয়ে কোনো রকমে ট্রেনটি চালানো হচ্ছে। বর্তমানে কালনী এক্সপ্রেসে নেই কোনো খাবার গাড়ি ও এসি কোচ।
এ সব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেস এই দুটি ট্রেনের কারণে তিনি বিব্রত। তার মন্ত্রণালয়ে এ দুটি ট্রেনের সেবা নিয়ে অভিযোগ আসায় নতুন কোচ দেওয়া হচ্ছে। তবে পূর্বাঞ্চলের যে রুটগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেই রুটে পর্যায়ক্রমে নতুন ট্রেন দেওয়া হবে।
রেলপথমন্ত্রী বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০ কোচ আসছে। সেগুলো থেকে রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেসে দেওয়ার পর বাকিগুলো সিলেট রুটে দেওয়া হবে।’
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চলে একের পর এক নতুন ট্রেন চালুর ফলে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল বেড়ে গেছে। যে কারণে সেতু দিয়ে ট্রেন পারাপারে ঝুঁকি বেড়েছে। এমনকি একই অঞ্চলে একের পর এক ট্রেন চালুর ফলে শিডিউল বিপর্যয় বাড়ছে।
নতুন ট্রেন বা কোচ বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান বলেন, ‘যেসব ট্রেন পুরাতন ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে সেগুলোতে পর্যায়ক্রমে নতুন কোচ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে নতুন ট্রেন দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন।’
রেলওয়ে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। যেখানে লাখ লাখ তরুণ যুক্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এমন একটি গ্রুপের সক্রিয় সদস্য আসিফ আহমেদ বলেন, ‘নতুন কোচ বা ট্রেন বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগে পূর্বাঞ্চলের অগ্রাধিকার ছিল। তবে সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম রুটেই বেশি বরাদ্দ যেত। কিন্তু এখন রেলমন্ত্রীর কারণে পশ্চিমাঞ্চল অগ্রাধিকার পাচ্ছে বেশি। কারণ ওই এলাকায় রেলমন্ত্রীর বাড়ি।’
ট্রেনে নিয়মিত যাত্রায়াত করেন সৌমেন ধর। তিনি বলেন, ‘সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে সেমি ননস্টপ একটি ট্রেন দরকার। এছাড়া সিলেট-ময়মনসিংহ রুটেও প্রচুর মানুষ যাতায়াত করে। সে রুটেও ট্রেন দরকার।’
কেন সিলেট রুটে বিপুল যাত্রী চাহিদা থাকার পরও কেন ট্রেন দেওয়া হয়নি?- এমন প্রশ্নের জবাবে রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে পুরাতন ট্রেনে নতুন কোচ সংযোজন করা হবে। এখন মিটারগেজ কোচ আসা শুরু হয়েছে। প্রথমেই রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেসে নতুন কোচ সংযোজন করা হবে। এরপরই সিলেট রুটের ট্রেনগুলোতে নতুন কোচ দেওয়া হবে। তবে ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা নতুন কোচ দিয়ে আপাতত আর কোনো নতুন ট্রেন চালুর সম্ভাবনা নেই।’
এদিকে ঢাকা-সিলেট রুটে ননস্টপ ট্রেনের দাবি দীর্ঘদিনের। আর ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে পুরাতন জরাজীর্ণ ট্রেন সরিয়ে নতুন কোচে ট্রেন দিতে বেশ কয়েকবার দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। এমনকি ডিও লেটারও দেওয়া হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। এর আগেও তাঁরই বড় ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেট রুটে ট্রেন চেয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন।
গত জুনেও সিলেটের ক্ষমতাসীন দল ও বিশিষ্টজনদের সমন্বয়ে একটি দল রেলপথ মন্ত্রণালয়ে যায়। ওই সময় তারা সিলেট রুটে ননস্টপ ট্রেন ও জরাজীর্ণ কালনী ও উপবন এক্সপ্রেস বদলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসেন।
সেই দলে নেতৃত্ব দেওয়া রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আহমেদ আল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘চার বছর আগেই সিলেট রুটে ট্রেন দেওয়ার দাবি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছিল। কিন্তু নতুন ট্রেন ও কোচ বণ্টনে বারবার অবহেলিত থেকেছে ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুট।’
এদিকে সিলেটের ক্ষমতাসীন দল ও বিশিষ্টজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রেলপথ মন্ত্রণালয় তাদের আশ্বস্ত করেছে যে, নতুন কোচ আসলে প্রথমেই সিলেট রুটে দেওয়া হবে। তবে নতুন কোনো ট্রেন চালু হবে না। পুরাতন ট্রেনগুলোতেই নতুন কোচ সংযোজন করা হবে।