দিনমজুর মায়ের মেয়ে ঢাবি মেধাতালিকায়, ভর্তিতে অনিশ্চয়তা
৩ অক্টোবর ২০১৯ ০৯:০৪
ঢাকা: কুষ্টিয়া মিলপাড়ার তুলাশ্রমিক মা আরজিনা বেগমের ( ৪৩) মেয়ে সুবর্না খাতুন। তার জন্মের পরের বছরই রিকশাচালক বাবা বাবুল হোসেন মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। এরপর তাদের আশ্রয় জোটে মামার বাড়িতে। কিন্তু বছর পাঁচেকের মাথায় সুবর্নার পড়ালেখার খরচ আর নানীর দেখভালের দায়িত্ব এসে পড়ে মা আরজিনার কাঁধে। দিনে দুইশ টাকার পারিশ্রমিক, আর হোটেলে টুকটাক কাজ করে সুবর্নার পড়ালেখা চালিয়ে যান আরজিনা।
দিনমজুর মায়ের সেই লড়াইয়ে আলোর মুখ দেখিয়েছে মেয়ে সুবর্না। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ‘গ’ ইউনিটের মেধা তালিকায় ৯২৭ নম্বরে এসেছে সুবর্না খাতুনের নাম। কিন্তু এই খবরে আনন্দের চেয়ে দুশ্চিতার পাল্লাই বেড়েছে মা-মেয়ের। এখনো তারা জোগাতে পারেননি ভর্তির ১৩ হাজার টাকা।
বুধবার (২ অক্টোবর) সুবর্নার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। সুবর্না বলেন, মায়ের পক্ষে ভর্তির এতগুলো টাকা জোগাড় করা সম্ভব না। নিজে টিউশনি করে যা জুগিয়েছিলাম, তা তো ভর্তি পরীক্ষার ফরম আর ঢাকা আসা-যাওয়ার খরচ মেটাতেই শেষ। মাকে নিয়ে কাল পৌরসভা চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি দরখাস্ত করতে বলেছেন। হয়তো কিছু ম্যানেজ হবে। না হলে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজেই পড়ব।
সুবর্নার বিষয়ে কথা হয় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মো. সাইফুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সুবর্না অসম্ভব মেধাবী। কিন্তু মেয়েটার বাবা নেই, খুব দরিদ্রও। আমাকে ওর একজন স্কুল শিক্ষক এ বিষয়ে জানান। আমরা যতটুকু পেরেছি ওকে সাহয্য করেছি। আমার কাছে ইংরেজি পড়ত। ইংরেজিতেও সে খুবই ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে আমি ওকে কুষ্টিয়া ইউসিসি কোচিংয়ের একজনের কাছে পাঠায়। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। রেজাল্টের পর আমাকে ফোন দিয়েছেল সুবর্না-খুশীর চেয়ে মন খারাপ ছিল বেশি। বললো, স্যার চান্স পেয়ে তো আরও বিপদে পড়লাম। এতো টাকা কোথায় পাব?
এমন যখন আর্থিক দুরাবস্থা, তখন কিভাবে এতটা পথ এলেন— জানতে চাইলে সুবর্না বলেন, আম্মু আর আমার ইচ্ছা, এর সঙ্গে শিক্ষকদের সহযোগিতাতেই পেরেছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে বইয়ের সৌজন্য কপি চেয়ে নিতাম। পরীক্ষার আগে দুয়েকমাস পড়াতেন বিনা পয়সায়। পরীক্ষায় সবসময় প্রথম না হয় দ্বিতীয় হতাম। তাই শিক্ষকরা খুব স্নেহ করতেন। সহযোগিতা করতেন। এভাবেই এসএসসি আর এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছি।
সুবর্না এসএসসি পাস করেন ২০১৬ সালে। তবে সে বছর আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি তার। টাকার অভাবের কারণেই একবছর পড়ালেখা বন্ধ ছিল তার। পরে কিভাবে আবার শুরু করলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে সুবর্না বলেন, প্রথমে হতাশ হয়ে পড়ি। দুই-তিন মাস কিছুই ভালো লাগত না। পরে কলেজে ভর্তি হওয়া বান্ধবীদের কাছে খোঁজ নিই, কত টাকা খরচ হয় কলেজের লেখাপড়ায়। এরপর শুরু করি এলাকার ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো। এই টিউশনির টাকা থেকে মাকে কিছুটা সাহায্য করি। আর বাকি টাকা জমাতে থাকি। সেই জমানো টাকা দিয়ে ২০১৭ সালে ভর্তি হই কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে।
দুই বছর পর এইচএসসি পাস করেছেন। ঢাবি বাণিজ্য অনুষদে ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাতেও স্থান পেয়েছেন মেধাতালিকায়। কিন্তু দুই বছর আগের অনিশ্চয়তা যেন আবার জেঁকে ধরেছে সুবর্নাকে। ঢাবি’তে ভর্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলেও যে আর্থিক সক্ষমতায় এখনো পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে!
সুর্বনা বলেন, আগামী ২৭ অক্টোব থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু ঢাকায় আমাদের পরিচিত বা আত্মীয় কেউ নেই। আম্মু তাই যেতে দিতে চাচ্ছেন না। আবার ভর্তি যে হবো, সেই টাকাও নেই। জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে। কিন্তু আমি পড়বই— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারি, কুষ্টিয়ার কলেজে পড়ব। টিউশনি করে হলেও পড়ালেখা চালিয়ে যাব।
আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে হেসে ওঠেন সুবর্না। সে হাসিতে অবশ্য আনন্দ নেই, আছে নিদারুণ বাস্তবতার যে পরিহাস, তারই প্রতিচ্ছবি। বলেন, একটাতে ফরম তুলে পরীক্ষা দিতেই তো সব টাকা শেষ। অন্য কোথাও ফরম তোলার টাকাই ছিল না।
বলতে বলতে তিনি তুলে ধরেন আরও একটু কঠিন বাস্তবার চিত্র— ‘সায়েন্সে পড়িইনি টাকা বেশি খরচ হবে বলে। আমাদের মা-মেয়ের সংসারে আমরা ভাত-আলু ভর্তা আর ভাজি খেয়ে কোনোরকমে দিন কাটাতাম। কালেভদ্রে পাতে মাছ জোটে। আর মাসং? হ্যাঁ, একবছর পর পর কোরবানির ঈদ এলে প্রতিবেশীরা কেউ কেউ মাংস দেই, ওটুকুই যে কয়েকদিন খেতে পাই।’ বলতে বলতে থেমে যায় মোবাইলের ওপারের কণ্ঠ।
একটু বিরতি নেন। ঠিক এই সময়ে কী জিজ্ঞাসা করা যায়, ভেবে পাই না সেটাও। কিছুক্ষণ পর সুবর্নাই জানতে চান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখায় কি অনেক খরচ হয়? আমাদের এলাকার কেউ তো ওখানে পড়ে না, বা পড়লেও আমি চিনি না। তাই ধারণা করতে পারছি না ওখানে কেমন খরচ। এখানে তো শিক্ষকরা বিনা পয়সসায় পড়াতেন বা দেখিয়ে দিতেন। ওখানে কি তেমন কোনো সুযোগ হবে?’
প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা অবশ্য করেন না সুবর্না। বলেন, অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। আম্মু একবার বলে যা, আবার বলে যাস না— অত বড় শহর, সবাই অচেনা। শেষ পর্যন্ত কী হবে, জানি না।
স্থানীয় সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী বা অন্য কারও কাছে কখনো পড়ালেখার বিষয়ে সাহায্য চেয়েছেন কখনো?— জানতে চাইলে সুবর্না ছোট করে উত্তর দেন, ‘না।’
কথা শেষ হওয়ার ঠিক আগে সুবর্না বলেন, খরচের কারণে বিজ্ঞান পড়তে না পারলেও পরে বাণিজ্য বিভাগ বেছে নিয়েছেন চিন্তাভাবনা করেই। ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতে ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন— এমনটাই লক্ষ্য তার। সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে এখন পর্যন্ত নিজের মেধার সর্বোচ্চ স্বাক্ষর রেখেছেন সুবর্না। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই অদম্য মেধাবীর বাকি পথটুকু এগিয়ে নিতে কেউ পাশে থাকবেন কি? সুবর্নার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার (Account Name. Arzina. DBBL AC. 017492666422).
কুষ্টিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাবি বাণিজ্য অনুষদ মেধাবী সুবর্না সুবর্না