পায়ে প্যাডেল, গলায় গান
৩ অক্টোবর ২০১৯ ১৮:৫৮
ঢাকা: ধানমন্ডির হাজারীবাগের বটতলার বালুর মাঠ ঘেঁষা এলাহী রিকশা গ্যারেজ। এখানকার জরাজীর্ণ পরিবেশে অন্যদের সঙ্গে গাদাগাদি করে দিন কাটে রিকশাচালক জহুরুল ইসলামের। দিনভর রিকশা চালান। পকেটে কিছু টাকা জমলেই দেন বিরতি। দরাজ গলায় গেয়ে ওঠেন গান। সেই গানের সূত্র ধরেই রিকশাচালক জহুরুল এখন ভাইরাল অনলাইনে। রীতিমতো ‘ফেসবুক সেলিব্রেটি’তে পরিণত হয়েছেন। দিন নেই রাত নেই, মোবাইলে একের পর এক কল আসছে। ডাক পড়ছে পত্রিকা অফিস, টিভি চ্যানেলেও।
জহুরুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ঠিক তেমন প্রমাণই পাওয়া গেল। তার দরদি কণ্ঠের গান শুনতে বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) টিম সারাবাংলা যখন এলাহী রিকশা গ্যারেজে, তখন সবে বেলা ফুটতে শুরু করেছে। জহুরুল তখনো কাঁঠের পাটাতনের দোতলার টঙে আধো-ঘুমে। তার ঘা ঘেঁষে শুয়ে আছেন আরেকজন। আশপাশে আরও বেশ ক’জন। তাদের মাথার একটু ওপরেই কটকট শব্দে ধীরে ঘুরছে একটি পুরোনো জং ধরা সিলিং ফ্যান।
ডাক দিতেই উঠে বসেন জহুরুল। বললেন, ‘সারারাত ঘুম হয়নি। গলাটা বসে গেছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন ডেকেছিল। অনেক রাতে ফিরেছি। আজও অনেকেই আসবেন বলেছেন। গতকাল দু’জন ফোন দিয়েছিলেন, আমার গানের অ্যালবাম করবেন বলে জানিয়েছেন।’ কেমন লাগছে এই গানকেন্দ্রিক ছুটোছুটি— এমন প্রশ্নে জহুরুল বলেন, ভালোই লাগছে। কিন্তু বিশ্রাম পাচ্ছি না।
গানের শুরুটা কিভাবে— জানতে চাই জহুরুলের কাছে। বলেন, গান আমার ভীষণ ভালো লাগে সেই ছোটবেলা থেকেই। বিশেষ করে আধুনিক গান। গোটা বিশেক গান মুখস্ত আছে। কখনো শেখার সুযোগ পাইনি। তবে গত বছর একজন যাত্রী হঠাৎ আমার গান শুনে উনার বাসায় নিয়ে যান। পরে জানলাম, উনি সংগীতের ওপরেই পড়ালেখা করেছেন। উনিই আমাকে হাতে ধরিয়ে তাল -লয়-সুর বুঝিয়েছেন। সারগাম শিখিয়েছেন। উনি অবশ্য এখন আর ঢাকায় থাকেন না।
মিষ্টি হেসে বিনয়ী ভঙ্গিতে জহুরুল বলতে থাকেন, বেশিক্ষণ রিকশা চালাতে ভালো লাগে না। ক্লান্ত লাগে। আমি তো চা-সিগারেট খাই না। এই রিকশার গ্যারেজে রিকশার জন্য দিনে শুধু ১০০ টাকা দিতে হয়। থাকা ফ্রি। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর মতো আয় হলেই আর অত চালাই না। সুযোগ পেলেই নিরিবিলি জায়গায় বসে গান গাই।
রিকশাচালক জহুরুল হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে আসেন মঙ্গলবার (১ অক্টোবর)। সেদিন গলায় কিংবদন্তী মান্না দে’র ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন এস এম সুজা উদ্দিন নামে একজন। জহুরুলের দরাজ কণ্ঠ আর চমৎকার গায়কী সেই ভিডিওকে ভাইরাল করে তোলে। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট লাখ বার দেখা হয়েছে সেই ভিডিও।
সেদিনের কথা জানতে চাইলে জহুরুল বলেন, “সেদিন সন্ধ্যায় দেখি রাস্তায় গিটারসহ গানের আড্ডা। পাশে গিয়ে রিকশা থামাই। আমাকে দেখে এস এম সুজা উদ্দিন নামের এক ভাই বলেন, ‘কী, গান গাইবেন?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হই। সেই গান নাকি মোবাইলে দিসেন উনি। কাল দেখালো টিভির লোকেরা। এখন তো সবাই ফোন দিচ্ছেন।” জহুরুলের সঙ্গে যতটুকু সময় ছিলাম, নির্বিঘ্নে কথা বলার উপায়ই নেই। একের পর এক ফোন আসছে তার মোবাইলে।
জানতে চাই ব্যক্তি জহুরুলের কথা। জানান, সিরাজগঞ্জ সদরের বাকবাটি গ্রামে তাদের বসবাস। ছোটবেলাতেই হারিয়েছেন বাবাকে। তাই ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের কাজ করে আয়-রোজগার করেছেন। মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানের পরিবার চলে তার উপার্জনেই।
জহুরুল বলেন, ‘আমি মায়ের এক ছেলে। তাই সংসার চলে আমার রোজগারেই। রাজমিস্ত্রির কাজ, মাঝি বা জেলেদের কাজ, তাঁত বোনা— সবই পারি। সেই ছোটবেলা থেকে তো এসব করেই চলছি।’ সংসার চালাতেই পেটের তাগিদেই তাই একটা সময় রাজধানীতে আসেন জহুরুল, জীবিকা হিসেবে বেছে নেন রিকশার প্যাডেল।
কেমন লাগে এই রিকশাচালকের জীবন?— জানতে চাইলে জহুরুল বলেন, ‘রাতে ঘুমাতে কিছুটা সমস্যা হয়। মশা কামড়ায়, গরম লাগে খুব। এখন অবশ্য সহ্য হয়ে গেছে। খারাপ লাগে না আর।’ তবে যে কথাই বলেন না কেন, ঘুরে ফিরে চলে আসে গানের কথা। বলেন, ‘জীবনে তো অনেক কিছু করেছি। কিন্তু বরাবরই গানটা খুব ভালোবাসি। কোথাও গান বাজলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম। শেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমার গান সবাই পছন্দ করে। ফোন দিলে ছেলেমেয়েরা বলে, বাবা গান শোনাও। আমার বউ পারভীনও আমার গান পছন্দ করে।’
https://youtu.be/G69xh5oqc2E
জহুরুল জানালেন, মাসে একবার বাড়ি যান ছেলেমেয়েদের দেখতে। নিজে স্কুলের গণ্ডি না পেরোলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে চান। বড় ছেলে ক্লাস সেভেনে, আর মেয়ে পড়ছে ক্লাস থ্রিতে। ওদের লেখাপড়া শেখাবেন, মানুষ করবেন— গান গাওয়ার বাইরে এটুকুই চাওয়া জহুরুলের।
বাকবাটি গ্রামে মায়ের ভিটেতে একটি ছোট ঘর তুলেছেন জহুরুল । কিন্তু সেখানে বের হওয়ার মতো রাস্তা নেই। তাই বাড়ি গেলে মন খারাপ হয়। অবশ্য আশায় আছেন, একদিন ওখানেও রাস্তা হবে। আর তেমন কোনো বড় স্বপ্ন নেই তার। কিন্তু যদি অন্য কোনো সুযোগ পান, তাহলে রিকশা চালানো ছেড়ে দেবেন বলে জানান তিনি।
এলাহী গ্যারেজের অন্য রিকশাচালকরাও গানের কারণেই জহুরুলের খুব ভক্ত। তারা বলেন, ‘খুব ভালো ছেলে। কারও সাতে-পাঁচে নাই। নিজের মনে গুনগুন করে গান গায়। কিন্তু গলা ছেড়ে গান গায় না, পাছে অন্য কারও ঘুম ভাঙে।’