নিকলি হাওর: পানকৌড়ি, সাদা বক আর জলের গল্প
৪ অক্টোবর ২০১৯ ১১:০৭
বাঁশের কোটায় জলজ পাখি পানকৌড়ির ডানা ঝাঁপটানি, চোখের সামনে উড়ে যাওয়া সাদা বকের দল, ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য— কোনটা বেশি নৈসর্গিক? এই প্রশ্নের জবাব যেমন হুট করে দেওয়া যায় না, ঠিক তেমনি মর্তের বুকে এক টুকরো ‘স্বর্গ’ নিকলির অপার্থিব সৌন্দযের বর্ণনা ‘কাঁচা’ হাতের লেখায় তুলে আনা যায় না। সুতরাং শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো— কাঁচা হাতে লেখা পানকৌড়ি, সাদা বক আর জলের গল্পে না মিটবে তৃষ্ণা, না মিটবে পিপাসা!
তবুও টানা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সড়ক পথে ভ্রমণের পর দুপুর সাড়ে ১২টায় বাচ্চু মিয়ার নৌকায় নিকলি হাওরে ভাসামাত্র বাঁশের কোটায় পানকৌড়ির ডানা ঝাঁপটানি দেখে ভেতরে যে স্বর্গীয় আনন্দ খেলে গেল, তা ভ্রমণ পিপাসুদের সঙ্গে ভাগ করা দরকার বৈকি!
মধ্য আশ্বিনের ভরদুপুর। রোদের চোখ রাঙানিটা যেমন হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তেমনটি নয়। হাওরের ওপর নীল আকাশ জুড়ে তুলার মতো মেঘ। সুযোগ পেলেই উদ্বীপ্ত সূর্যটাকে কালো পর্দায় ঢেকে দিচ্ছে মেঘবালিকারা। নিটোল ভঙ্গিতে বয়ে যাচ্ছে আলতো বাতাস। হাওরের বিশাল জলরাশিতে নেই বাড়াবাড়ি রকমের ঢেউ! তিন ঘণ্টার জন্য ১২শ টাকায় ভাড়া করা বাচ্চু মিয়ার নৌকা নিথর জলের বুকে মৃদু ঢেউ তুলে ছুটছে গন্তব্যের দিকে।
নৌকায় ছয় জোড়া কৌতূলী চোখ। ইট, কাঠ, কংক্রিট, ময়লার স্তূপ আর যানজট দেখতে দেখতে ক্লান্ত চোখগুলো ঢাকার জঞ্জাল থেকে সে মুহূর্তে ১৩০ কিলোমিটার দূরে। পথের পাশে সবুজ ধানক্ষেত, রাস্তার ধারে সারি সারি কলাগাছ, শুকিয়ে যাওয়া মাঠে সাদা-কালো-ধূসর রঙের গাভী, হাওর শাসন করা বেড়িবাঁধে নক্ষত্রের মতো হাঁস দেখে দেখে এরই মধ্যে উধাও চোখের ক্লান্তি।
নৌকার বাম পাশে হঠাৎ পানকৌড়ি। দূর থেকে উড়ে এসে বাঁশের কোটায় বসে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে অসম্ভব সুন্দর জলজ পাখিটি। পালকে লেগে থাকা পানি ঝেড়ে ফেলে দূরে… আরও দূরের গন্তব্যে উড়াল দেওয়ার প্রস্তুতি তার! প্রথম যে জন দেখল এই অপূর্ব দৃশ্য, তার গর্বিত চোখ অন্য চোখগুলোকে ডেকে নিল পাখিটির দিকে। শুরু হলো কানাকানি, কী নাম জানি পাখিটির?— এটা পানকৌড়ি!
সকালের ঘুম অসম্পূর্ণ রেখে ভোর ৬টায় কিশোরগঞ্জ নিকলি হাওরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ায় মনের মধ্যে কম ঘুমানোর যে কষ্ট জমে ছিল, সেটা পানকৌড়ির ডানায় ভর দিয়ে যেন নীলিমায় হারিয়ে গেলে। ক্রমশই দৃষ্টিসীমার কাছে আসতে লাগল হাওর যাত্রার প্রথম গন্তব্য ‘ছাতির চর’।
নিকলি বেড়িবাঁধ থেকে নৌকাযাত্রা শুরুর সময় মাঝি বাচ্চু মিয়া বলেছিলেন, ৪৫ মিনিট লাগবে ছাতির চর যেতে। সে না হয় লাগল। কিন্তু ছাতির চর কেন যাচ্ছি? সেখানে গিয়ে কী দেখা যাবে? যেতে যেতেই বা কী দেখব? বিশাল এই হাওরে আর কী কী দেখার আছে? তাছাড়া নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানোই কি যথেষ্ট নয়?— মনের মধ্যে এ রকম নানা প্রশ্নের ভিড়!
হঠাৎ হাতের ডান পাশে দেখা মিলল অপূর্ব এক দৃশ্য। প্রায় মাঝ হওরে এই ভরদুপুরে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে তিন জন লোক ছিপ দিয়ে মাছ ধরছেন। যে জায়গাটাতে তারা দাঁড়িয়েছেন, সেখান থেকে হাওড়ের দুই পাশের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। বাকি দুই পাশের দূরত্ব অনুমানযোগ্য নয়। নৌকার মাঝি পঞ্চাশোর্ধ্ব বাচ্চু মিয়া জানালেন, নিকলি, কটিয়াদী, বাজিতপুর, ইটনা, মিঠামইন, করিমগঞ্জ, কুলিয়ারচর— এই সাতটি উপজেলা হাওরের চারদিক ঘিরে।
বেলে মাছ, ট্যাংরা মাছ, বাইম মাছ, আইড় মাছ, টাকি মাছ, পুটি মাছ, শোল মাছসহ নানা প্রজাতির মিঠা পানির মাছ ধরার জন্য এই তিন জনের মতো অসংখ্য মৎসজীবী সারাদিনমান নিকলি হাওরে পড়ে থাকেন। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মাছ পেলে ছোট্ট ডিঙি নৌকায় চড়ে বাড়ি ফেরেন তারা। হাওরে মাছ ধরার এই দৃশ্যও ভ্রমণ পিয়াসী লোকদের নিয়ে যেতে পারে আনন্দলোকে।
নিকলি হাওরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী। স্থানীয়রা নদীটির নাম দিয়েছেন ঘোরপর্তা নদী। কী করণে নদীটির নাম ‘ঘোরপর্তা’ হলো, তার প্রকৃত ব্যাখ্যা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এটুকু অনুমান করা যায়, ঘোর না কাটা রেশের কারণেই নদীটির নাম ‘ঘোরপর্তা’ রাখা হয়েছে। যেমন— অপার্থিব সৌন্দযের আগুনে পোড়াতে সক্ষম এ নদীরই একটি চরকে পর্যটকেরা নাম দিয়েছে মনপুরা!
নদীর দু’কুল ছাপিয়ে বিশাল জলরাশি দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের সঙ্গে মিশে থাকায় বছরের ছয় মাস ঘোরপর্তার অস্তিত্ব ঠাহর করা যায় না। তবে বালু, পাথর, সুরকিবাহী দৈত্যাকার জাহাজ চলাচলে বোঝা যায় ‘এইখানে এক নদী আছে’! নৌকার মাঝি বাচ্চু মিয়ার ধারণা, ঘোরপর্তা নদী ২৬০ ফুট গভীর। কোনো কালেই এই নদীর পানি শুকায় না!
বড় বড় জাহাজকে পাশ কাটিয়ে নৌকা চলছে ‘মিনি রাতারগুল’ ছাতির চরের দিকে। নিকলি বেড়িবাঁধ থেকেই এই ‘মিনি রাতারগুলে’র ঝাপসা অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়। টানা ৪৫ মিনিট নৌকা ভ্রমণের পর ‘মিনি রাতারগুল’ এই মুহূর্তে আর ঝাপসা নয়। রীতিমতো স্পষ্ট।
নৌকা থেকে নেমেই ‘মিনি রাতারগুলে’ শুরু হলো দৌড়াদৌড়ি। ১৩/১৪ বছরের রুবেল-জসিমরা সারাদিন ফুটবল নিয়ে অপেক্ষায় থাকে পর্যটকদের জন্য। ২০/৩০ টাকা দিলে ঘণ্টাখানেকের জন্য ওদের ফুটবল পর্যটকদের হয়ে যায়। শুরু হলো ফুটবল খেলা!
কখনো ফুটবল, কখনো এলো-মেলো সাঁতার, কখনো উল্টা-পাল্টা ডুব। কখনো ঘোরপর্তা নদীর স্রোত মাপতে যাওয়া, কখনো ফটোসেশন, কখনো হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে জাম্বুরা-ঝালমুড়ি খাওয়া, কখনো অন্য পর্যটকদের দিকে অপলোক তাকিয়ে থাকা— এভাবেই কেটে গেল ঘণ্টাখানেক সময়। অতঃপর ‘মিনি রাতারগুল’ ছাতির চর থেকে এবার গন্তব্য মনপুরা চরে।
গত দেড় ঘণ্টা যতটুকু দেখা, তাতেই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু, ঈশ্বর তো কৃপণ নয়। দেবার সময় তিনি উজাড় করেই দেন। রোদহীন আকাশের নিচে ঝিরি ঝিরি বাতাস। মাঝারি মাপের ঢেউ নৌকার গলুইয়ে লেগে ঝপাত ঝপাত শব্দে দ্বিখণ্ডিত হতে লাগল। নৌকার ছইয়ে টাঙানো ছামিয়ানা খুলে দিলেন বাচ্চু মিয়া। আকাশ আরও কাছে চলে এলো!
হঠাৎ এক ঝাঁক সাদা বক নৌকার ডান পাশ দিয়ে উড়ে গেল! আরেকটু দূরে একটি পাকনৌড়ি। পানকৌড়িটি কিছুটা বাঁক নিয়ে নিকলির লোকালয়ের দিকে ছুটল। আর সাদা বকের গন্তব্য সোজা মনপুরা চর। নৌকার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উড়ছে বকেরাও। মনপুরা চরে নৌকা ভেড়ার আগেই ঘন কাশবনে গিয়ে বসল তারা ঝিনুকখোলা মুক্তোর মতো।
মনপোড়া চর খুব বড় নয়। চারদিকে বিশাল জলরাশী। জলের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘোরপর্তা নদীর নিবিড় স্রোত, সহনীয় দূরত্বে হিজল আর তমালের সারি, ছোট ছোট ডিঙি নৌকা, নৌকার ছইয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চু মিয়ার সালাত আদায় এবং মনপোড়া চরে রাখালের ঘাস কাটার দৃশ্য দেখে মুহূর্তে হারিয়ে যায় মন।
হাওরের বিশাল জলরাশির নিচে হারিয়ে যাওয়া ঘোরপর্তা নদীর স্বচ্ছ পানিতে দুপুর বেলার স্নান শেষ হলো ঘড়ির কাটায় বাঁধা নির্দয় সময়ের চাপে। সবাইকে উঠতে হলো নৌকায়। এবার গন্তব্য তীরের দিকে। সেখানে পৌঁছে ঢেকিছাঁটা চালের গরম ভাত, গুচি-বাইম-বেলে-চিংড়ি-বোয়াল মাছের ঝোল, পাতি হাঁসের মাংস আর পাতলা ডাল দিয়ে দুপুরের আহার শেষ হলো। এবার ফেরার পালা…।
লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা ডট নেট