Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে ‘অতিথি’ বিএনপি নেত্রী, তুমুল সমালোচনা


৫ অক্টোবর ২০১৯ ২০:৪৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম নগরীতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিএনপি নেত্রীর বক্তব্য দেওয়া নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

অনুষ্ঠানে নাছিরকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মেয়র’ হিসেবে উল্লেখ করে নিজ দলের মধ্যেই বিতর্কে পড়েছেন বিএনপি নেত্রী মনোয়ারা বেগম মণি। আবার দলীয় অনুষ্ঠানে বিএনপি নেত্রীকে অতিথি করা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষত মেয়রের উপস্থিতিতে বিএনপি নেত্রীর আওয়ামী লীগের মঞ্চে ওঠা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও চলছে সমালোচনা।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (০৪ অক্টোবর) সকালে নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ব্যানারে দুর্গাপূজা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠান হয়। নগরীর পশ্চিম মতিঝর্ণা বাটালি হিল এলাকায় এই অনুষ্ঠানে লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিক আহমেদ এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমও বক্তব্য রাখেন। ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে একমাসেরও বেশি সময় জেল খেটে সম্প্রতি জামিনে বের হন মাসুম।

একই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেওয়া মনোয়ারা বেগম মণি চট্টগ্রাম নগর মহিলা দলের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত (লালখান বাজার, জামালখান ও এনায়েত বাজার) ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা এই নেত্রী তখন নাশকতার অভিযোগে একাধিক মামলার আসামিও হয়েছিলেন। টানা তিনবার নির্বাচিত এই কাউন্সিলর পরে সব মামলা থেকেই অব্যাহতি পেয়েছেন বলে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

মেয়রের উপস্থিতিতে সেই মণিকে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি হননি। নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলির এক সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফ্রিডম পার্টির নেতারা এসে যুবলীগ করছে। বিএনপি নেত্রীর দেহরক্ষীকেও নেতারাই আশ্রয় দিচ্ছে। এটাও একই ঘটনা। মেয়র আমাদের দলের নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক। উনার উপস্থিতিতে বিএনপির একজন নেত্রী দলের অনুষ্ঠানে কিভাবে বক্তব্য রাখেন, যদি উনার সম্মতি না থাকে। যে নেত্রী পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ নাশকতায় অভিযুক্ত, তাকে আওয়ামী লীগের প্রোগ্রামে আনা মানে তাকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া।’

নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে হাইব্রিডদের এনে রাজনীতি করার এই চর্চা আগে ছিল না। এখন নতুন করে এই চর্চা শুরু হয়েছে। দলের ত্যাগী নেতাদের অসম্মান, অবমূল্যায়ন, প্রয়াত নেতাদের যথাযথ সম্মান না দিয়ে হাইব্রিডদের হাতে দলকে তুলে দেওয়ার এই কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নেতাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। শুধু বিএনপি নেত্রী নয়, সন্ত্রাসী-খুনের মামলার আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দেওয়া হচ্ছে। আমরা যারা আওয়ামী লীগের দু:সময়ে মাঠে ছিলাম, এসব কর্মকাণ্ডে আমাদের ‍হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।’

আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে বিএনপি নেত্রীকে অতিথি করার বিষয়ে জানতে চাইলে লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম বলেন, ‘আমরা মনোয়ারা বেগম মণিকে অতিথি করিনি। মেয়র মহোদয় এসেছেন শুনে তিনি নিজেই অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। আমার কাছে এসে দুই মিনিট কথা বলার সুযোগ চান। তখন আমি তাকে মাইক দিই। যেহেতু সার্বজনীন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তিনি নিজ থেকে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সেজন্য আমি আপত্তি করিনি।’

জানতে চাইলে মনোয়ারা বেগম মণি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র সাহেব কোথাও যাবার আগে করপোরেশন অফিস থেকে ফোন করে স্থানীয় কাউন্সিলরদের জানানো হয়। লালখান বাজারে আসার আগে আমাকে জানানো হয়েছিল। সেজন্য আমি গিয়েছিলাম। আমি আওয়ামী লীগের প্রোগ্রামে যাইনি। আমি মেয়র সাহেবের প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম।’

আওয়ামী লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপি নেত্রী মঞ্চে থাকলেও সেখানে ছিলেন না নিজেদের দলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী এফ কবির আহমেদ মানিক। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বারবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

তবে স্থানীয় ও নগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিদারুল আলম মাসুমের সঙ্গে এফ কবির আহমেদ মানিকের একসময় ঘনিষ্ঠতা থাকলেও সম্প্রতি তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মাসুম আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লালখান বাজার থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনা আছে। মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে এলাকায় তার পরিচিতি আছে। মাসুম ও মানিকের অনুসারীদের মধ্যে এলাকায় বেশ কয়েকবার সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। এই অবস্থায় মাসুমের সঙ্গে এলাকায় ঐক্য গড়ে তুলেছেন বিএনপি নেত্রী মনোয়ারা বেগম মণি।

এদিকে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে বিএনপি নেত্রী মণি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন। পাশাপাশি তিনি ‘আওয়ামী লীগের ভেতরে মেয়রের বিরুদ্ধে অনেকে ষড়যন্ত্র করছেন’ বলে উসকানিমূলক কথাও বলেন।

মনোয়ারা বেগম মণি বলেন, ‘আজকে আমি আ জ ম নাছির উদ্দীন সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। উনাকে আমি যখন ডেকেছি, যেকোনো প্রোগ্রামে, নাক ফোঁড়ানো, একটু অসুস্থ রোগীকে দেখা…সবকিছুতেই উনি হজির হন। সকাল ৮টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত উনি জনগণের সাথে মিশে যান। উনি একঘণ্টাও রেস্ট নেন না। আমি নিজে দেখেছি। আমি অবাক হয়ে যাই, একজন মানুষ কিভাবে জনগণের জন্য এভাবে নিজেকে নিবেদিত করতে পারেন!’

মণি আরো বলেন, ‘আ জ ম নাছির একটা দল করেন, আমি আরেকটা দল করি। সেটাতে আমি বিশ্বাসী না। আমি বুঝি, দলমত ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার সেবা। মানবতার জন্য কাজ করাই হচ্ছে রাজনীতি, সমাজনীতি। কে কোন দল করে সেটা বিবেচনা করে আ জ ম নাছির কাজ করেন না। উনি একটা জায়গায় আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। কিন্তু উনি চট্টগ্রামের অভিভাবক। আগামী দিনেও আমরা আ জ ম নাছিরকে আবার মেয়র হিসেবে দেখতে চাই ইনশাল্লাহ। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আ জ ম নাছির সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মেয়র হবেন; আবার এখানে আসবেন। আমরা আবার ফুল দিয়ে বরণ করে নিব তাকে।’

তিনি বলেন, ‘উনি প্রতিটা ওয়ার্ডে কাজ করেছেন। কিন্তু সেটা বলার লোক খুব কম। উনার দলে উনার পিছনে ষড়যন্ত্র করছে। অন্য দল না। সাধারণ মানুষ আ জ ম নাছিরকে ভালোবাসে।’

মণি আরো বলেন, ‘যখন কেউ আ জ ম নাছিরের বিরুদ্ধে কিছু বলে, প্রতিবাদ করি। আমি তিনটা মেয়র পেয়েছি। মহিউদ্দীন চৌধুরী, মনজুর আলম (বিএনপি সমর্থিত) ও আ জ ম নাছিরকে পেয়েছি। আমার দৃষ্টিতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। আপনারা যদি আ জ ম নাছিরকে আবার নির্বাচিত করতে না পারেন সেটা হবে আপনাদের জন্য ব্যর্থতা, চরম ব্যর্থতা। নাছির ভাই নমিনেশন না পেলে আমি নির্বাচন করব না। নাছির ভাই ছাড়া অন্য কোনো মেয়রের অধীনে কাউন্সিলর হওয়ার ইচ্ছে নাই। অনেক করেছি, আর নির্বাচন করব কিনা সেটারও ঠিক নাই।’

এসময় মণি ‘আ জ ম নাছির একটি বিপ্লবের নাম’ বলেও মন্তব্য করেন। বক্তব্যের শেষ দিকে এসে তিনি দিদারুল আলম মাসুমেরও প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘মাসুম জনতার জন্য কাজ করে যাবেন। আগামীতে আমরা মাসুমকেও দেখব।’

আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়রের প্রশংসা করে বক্তব্য দিয়ে দলের মধ্যে বিপাকে পড়েছেন মনোয়ারা বেগম মণি। ফেসবুকে সমালোচনার পাশাপাশি তার বহিষ্কারের দাবিও তুলছেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা.শাহাদাত হোসেন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় মণির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনোয়ারা বেগম মণি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আবেগপ্রবণ হয়ে কিছু কথা বলে ফেলেছি। আমি ভুল করেছি। আমার দলের নেতাকর্মীরা জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করছেন। আমি তাদের মনে আঘাত দিয়েছি। আমি বুঝতে পারছি, আবেগপ্রবণ হয়ে আমার এভাবে কথা বলা উচিৎ হয়নি। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এরপরও দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমি সেটা মাথা পেতে নেব। আমি বিএনপির একজন্য সামান্য কর্মী হয়ে থাকতে চাই।’

আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম চট্টগ্রামের মেয়র

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর