Friday 04 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জামাল উদ্দীন ও ভারতীয় হাইকমিশনের গল্প


১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:১২ | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:৪৭
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেসবাহ শিমুল,সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ৮ ফেব্রুয়ারির পর রাজধানীর যান চলাচল যে ফের পুরনো চেহারায় ফিরে এসেছে তা বোঝা গেলো শনিবার সন্ধ্যায়। আজিমপুর থেকে নীলক্ষেত মোড়ের যে সিগনাল সেখানে গাড়িগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে। মোড়ের ট্রাফিক পুলিশগুলোর কোনো তৎপরতাই কাজে আসছেনা যানজট নিরসনে। তাই মোড়ের পশ্চিম পাশের ফুটপাতে বসে গাড়িগুলোর অবস্থা দেখছি। জানালা দিয়ে যে যাত্রীদের চোখে পড়ে তাদের শুকনো মুখগুলোয় রাজ্যের বিরক্তি। হায় আজই ফিরে এলো অসহনীয় যানজট!

কলোনীর ওয়াল ঘেঁষে দক্ষিণে চলে যাওয়া যে ফুটপাত সেখানে একটি বসার টুল রয়েছে। কংক্রিটের তৈরি। সেখানে বসে সিগারেট বিক্রি করছেন ত্রিশোর্ধ এক যুবক। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার বেচাবিক্রি দেখলেও এখন মন চাইলো একটু বসে পড়ি। তাতে দীর্ঘক্ষণ গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকার যে ক্লান্তি তা ভুলে থাকা যাবে।

বিজ্ঞাপন

সিগারেট বিক্রেটার নাম জামাল উদ্দিন। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। তবে ছোটো বেলা থেকে আজিমপুর এলাকায়ই থাকেন। নিউমার্কেট-গাউসিয়া মার্কেটে নানা কাজ করে বেড়ে উঠা। এখানেই তার জীবন-জীবীকা।

সারাদিনে বেচা-বিক্রি কেমন হয়, এমন প্রশ্নে জামাল উদ্দীন বলেন, জানিনা ভাই, সারাদিনে হয়তো দেড়-দুইশো থাকবো। সিগারেটেতো লাভ নাই।

: তাহলে এ দিয়ে চলবে কীভাবে?

: কি করমু ভাই, কিছু করার নাই। এক মাস বেকার ছিলাম। এহনতো আর পারতেছিনা। তাই বাধ্য হইয়া রাস্তায় বইছি। বউ-বাচ্চা আছে, সংসারতো চালান লাগবো। কোনোমতে জোড়াতালি দিয়া চালাইতেছি আরকি।

কথাগুলো শুনে একটু খটকা লাগলো। কোথাও ঘাপলা আছে কি না বিষয়টি ধরতে কথা বাড়াই জামালের সঙ্গে। তিনি জানান, আজই ফুটপাতে সাড়ে তিন হাজার টাকার সিগারেট নিয়ে বসেছেন তিনি। সকাল আটটা থেকে এখন বাজে রাত আটটা। অর্ধেকের মতো এখনো বাকি। কয়েকটি ব্রান্ডের সিগারেট এখনো বিক্রিই হয়নি। প্রথম দিনতো বুঝতে পারি নাই ভাই।

প্রথম দিন মানে? আগে কি করতেন?

জামাল জানান, আগে ভারত থেকে কসমেটিক্সের মালামাল এনে নিউমার্কেটে বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু গত একমাস ধরে তা বন্ধ রয়েছে। তাই লাইনম্যানকে ধরে সকাল থেকে এখানে বসেছেন সিগারেট বিক্রি করতে। তাও শুধু আজকের জন্য।
তিনি বলেন, এখানে নিয়মিত সিগারেট বিক্রি করেন সুলতান নামের একজন। তবে সে আজ অসুস্থ। তাই একদিনের জন্য আমি এখানে বসেছি। কালকে থেকে হয়তো বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে হবে সিগারেট।

এবার আসি তার পুরনো ব্যবসা প্রসঙ্গে। কেন বন্ধ হলো ব্যবসা? জানতে চাইলে জামাল জানান, ভারতে যেতাম টুরিস্ট ভিসায়। ভিসার মেয়াদ থাকতো একমাস করে। এভাবে অনেকদিন করেছি। মাসে যা আসতো তাতে ভালই চলছিলো সংসার। কিন্তু এখন আর ভিসা নবায়ন করছে না হাইকমিশন। অনেকবার গিয়েছি, তারা সাফ বলে দিয়েছে টুরিস্ট ভিসা আর দিবেনা। বিজনেস ভিসা করতে বলছে। কিন্তু তা করতে যেসব কাগজপত্র লাগে তা আমার নাই। ট্রাভেলস কোম্পানিতে যোগাযোগ করেছি,তারা আমার কাছে দেড়লাখ টাকা চেয়েছে। বলেছে, এই টাকা দিলে প্রয়োজনীয় সব কাগজ তারা করে ভিসা পাইয়ে দেবে। কিন্তু এতো টাকা আমি পাবো কোথায়।

জামাল উ্দ্দীন কথা বলছেন। ফাঁকে পথচারিদের কেউ কেউ তার কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন পছন্দের সিগারেট। জানালেন, বেনসন, গোল্ডলিফ এর নেভী সিগারেট বেশি চলে। অথচ এই তিনটা ব্রান্ডেই লাভ কম। শতকরা ৬ থেকে ৮ টাকা থাকে।

ক্রেতা চলে গেলে জামাল ফিরে আসেন তার পুরনো গল্পে। বলেন, আগে মার্কেটে চাকরি করতাম ৮ হাজার টাকা বেতনে। তারপর বিয়ে করলাম। একসময় বন্ধুদের পরামর্শে ভারত থেকে খুচরা মালামাল আনতে শুরু করলাম। পাসপোর্ট করার পর ভিসা পেতে দালাল ধরতে হয়েছিলো। সেখানে অনেক টাকা গেছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশি দেশটির সঙ্গে নাকি সরকারের ভাল সম্পর্ক। কিন্তু তারা ভিসার জন্য এতো ঝামেলা করে কেন? প্রশ্ন করেন জামাল। তবে তা কেবলই প্রশ্ন। উত্তরের জন্য তার সময় নেই।

জামাল জানান, ৬ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। এখন অবস্থা এমন যে বেঁচে থাকাই দায়। ভাগ্য ভাল শাশুড়ি কিছুটা সাহায্য করছেন। তার টাকায় খাওয়াটা চলে। আর আমি ঘর ভাড়া দেবো। কাল সকালে যেহেতু পুরনো লোক এখানে আসবে। তাই আমি বাসে বাসে ফেরি করে সিগারেট বিক্রি করবো। কিছু করার নাই ভাই। বাঁচতে তো হবে।

ভিসা পাওয়ার আশা আছে কি না। জানতে চাইলে দীর্ঘ নি:শ্বাস নেন জামাল। তিনি বলেন, জানিনা পাবো কি না। ওখানে গিয়ে কোনো লাভ নেই। টাকা থাকলে দালাল দিয়ে কাজ করাতাম। কিন্তু তা কবে পারবো জানিনা।

প্রতিবেশি দেশ হলেও ভারতের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশিদের জন্য ক’দিন আগেও ছিলো অনেক কঠিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভবও। তবে ঢাকা্স্থ ভারতীয় হাইকমিশন কিছু উদ্যোগ নেওয়ায় সে বিড়ম্বনা কিছুটা কমেছে। কর্তৃপক্ষের দাবি ভবিষ্যতে আরো সহজ হবে ভারতীয় ভিসাপ্রাপ্তি। যদিও এসব কাগুজে আর কূটনৈতিক উদ্যোগ জামালের মতো এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য নয়।

রাত নয়টা বেজে আসছে। গল্প এখানো বাকি। তবে এরই মধ্যে জ্যামে থাকা গাড়িগুলোর পেছনের সিগনাল লাইট জ্বলে উঠেছে। আমিও গাড়ি ধরার জন্য নড়ে চড়ে উঠছি। জামাল বললেন, ভাই, উই…যে আপনার গাড়ি আসছে। আমি পড়িমড়ি করে গাড়ি ধরলাম। পেছনে পড়ে রইলেন জামাল। সে রাত ১২ টা পর‌্যন্ত সেখানে থাকবে। তার টার্গেট সাড়ে তিন হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি করা।

সারাবাংলা/এমএস

বিজ্ঞাপন

সবজির বাজার চড়া
৪ জুলাই ২০২৫ ১৬:৩০

আরো

সম্পর্কিত খবর