৬ বছরে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে ৮০ লাখ মানুষ: বিশ্বব্যাংক
৭ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:০১
ঢাকা: ছয় বছরে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বেরিয়ে এসেছে ৮০ লাখ মানুষ। এর অন্যতম কারণ শ্রম আয় বৃদ্ধি। এর ফলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
‘বাংলাদেশ পোভার্টি অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সোমবার (৭ অক্টোবর) রাজধানীর হোটেল ‘আমারী’তে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বিকাশ কিশোর দাস এবং বিশ্বব্যাংকের পোভার্টি অ্যান্ড ইক্যুইটি গ্লোবাল প্র্যাকটিসের গ্লোবাল ডিরেক্টর ক্যারেনিনা সানসেজ প্রমো। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্স মিয়াং টেম্বন। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ মারিয়া ইউজেনিয়া জেনননি।
প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় জেনননি বলেন, জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমাচ্ছে। তবে দারিদ্র্য কমছে তুলনামূলক কম গতিতে। ২০১০ সাল থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়লেও দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমেছে। এছাড়া দারিদ্র্য কমেছে অসমভাবে।
জেনননি আরও বলেন, ২০১০ সাল থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের বিভাগগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য পরিস্থিতির ঐতিহাসিক পার্থক্য আবার ফিরে এসেছে। পশ্চিমে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে এবং রাজশাহী ও খুলনায় একই জায়গায় রয়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামে দারিদ্র্য কমেছে পরিমিতভাবে এবং বরিশাল, ঢাকা ও সিলেটে দ্রুত কমেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। দারিদ্র্য নিরসনের এ তথ্য তিন বছর আগের। বর্তমান তথ্য আরও অনেক বেশি উৎসাহমূলক। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এ দেশের দারিদ্র্য নিরসনের মূল চাবিকাঠি। দেশে টেকসই ও মানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। প্রবৃদ্ধির এ অর্জন প্রত্যেক মানুষকে টাচ করছে। প্রত্যেক মানুষ অর্থনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য কমাচ্ছে। আশা করছি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এ দেশে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থাকবে না। দারিদ্র্য নিরসনে আমরা সঠিক পথেই আছি।
বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, গত দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এখনো প্রতি ৪ জনের একজন দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বাস করছেন। বাংলাদেশকে আরও অনেক কিছু করতে হবে, বিশেষ করে দারিদ্র্যের নতুন ক্ষেত্রগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। যেমন— শহর এলাকায় দারিদ্র্য মোকাবিলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের অর্ধেকেরেই বাস হবে শহরে।
তিনি আরও বলেন, গত দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের ৯০ শতাংশই গ্রামে হয়েছে। শহরে দারিদ্র্য কমছে সীমিত হারে এবং অতি দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে শহুরে অংশটি একই রয়ে গেছে। ফলে জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচনের গতি ধীর হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য নিরসন সাফল্যে অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০০০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। সেটি কমে ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশ, ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ২০০০ সালে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা ২৫ দশমিক ১ শতাংশ, ২০১০ সালে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ ও ২০১৬ সালে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কৃষি নয়, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য কমাতে শিল্প ও সেবা খাত বেশি অবদান রেখেছে। এসময়ে কৃষি প্রবৃদ্ধি ধীর ছিল এবং আগের চেয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে কম অবদান রেখেছে এই খাতটি। অন্যদিকে, শহর অঞ্চলে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাত, বিশেষত তৈরি পোশাক খাত দারিদ্র্য কমাতে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রেখেছে। আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, যা নগর দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করেছে।
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও প্রতিবেদনের সহ-লেখক মারিয়া ইউজেনিয়া জেননি বলেন, এই রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে যে প্রথাগত বিভিন্ন চালিকাশক্তি দারিদ্র্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু অগ্রগতি আনার ক্ষেত্রে কিছু চালকের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে।
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— দারিদ্র্য নিরসনের গতি কমেছে। এ ক্ষেত্রে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্য কমেছে বার্ষিক ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। পরে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এবং ২০১০ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দারিদ্র্য কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তৈরি হতে যাওয়া দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় শত বছরের ডেল্টা প্ল্যানের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষ্যম্যের বিষয়গুলোর সমাধান ঘটবে।