রাষ্ট্রের পবিত্রতায় বাংলাদেশের শুদ্ধতা
১০ অক্টোবর ২০১৯ ১৮:৩৬
রাষ্ট্রের পবিত্রতা ও সেলিম আল দীন . . .
রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে লেখক, নাট্যকার, বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা বা উপলব্ধি সবসময় চূড়ান্ত দর্শন বলে বিবেচিত হয়। যারা রাজনীতি করেন তারাও অনেক সময় এদের মতো নিখুঁত করে ভাবতে পারেন না। যারা ভাবেন তারা কালজয়ী রাজনীতিবিদ হন। অথবা যুগ বা কাল অতিক্রম করে ইতিহাসে চিরস্থায়ী হন।
দর্শন বা নাটকের আঁতুড়ঘর গ্রিস বলুন, প্রাচীন ইংল্যান্ড বা নতুন যুক্তরাষ্ট্রই বলুন- লেখক বা নাট্যকাররা যেভাবে ভেবেছেন রাষ্ট্র ব্যবস্থা সেভাবেই সংজ্ঞায়িত হয়েছে। রাষ্ট্র নিয়ে নতুন নতুন তত্ত্বগুলো তারাই বলেছেন। ভবিষ্যতেও বলবেন। তবে রাষ্ট্র নিয়ে বাংলাদেশের নাট্যাচার্য সেলিম আলদীনের একটি উপলব্ধি আমার কাছে চিরন্তন আধুনিক মনে হয়েছে। তিনি তার নিমজ্জন নাটকে বলেছেন, ‘রাষ্ট্র একটি পবিত্র ধারণা। যে রাষ্ট্র পণ্যের নামে অস্ত্র বিক্রি করে সেটা রাষ্ট্র হতে পারে না। যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।’
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র কিংবা রুশোর প্রকৃতি বা আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের যে ধারণা তা থেকে সেলিম আল দীনের রাষ্ট্রের ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা। আগেকার সবাই রাষ্ট্রের নাগরিকদের শান্তি ও সাম্যর কথা বলেছেন। সেলিম আল দীনই প্রথম বলেছেন, যে রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের জন্য, অন্য জাতির জন্য হুমকি হয়, অশান্তির কারণ হয় তা রাষ্ট্রই নয়। তিনি তার পবিত্র ধারণার আলোকে এ রকম ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকার করেছেন। তিনি এই কথাগুলো এমন এক সময় দাঁড়িয়ে বলেছেন, যখন বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রভাব বিস্তার করছে বা শাসন করছে। তিনি সরাসরি সেই শক্তিগুলোর নাম ধরে তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন। সেলিম আল দীনের এ তত্ত্ব যদি এক হাজার বছর পর টিকে থাকে (আমি আশাবাদী) তখন সেই সমাজ বা রাষ্ট্র তাঁর যে পবিত্র ধারণার উপর গড়ে উঠেছে তা নিয়ে গবেষণা করতে পারে।
সাব্রুমে ফেনীর পানি ও ভারতীয় তরুণীর উদ্বেগ…
কিছুদিনে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার আলোকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পবিত্রতার উপসংহার টানার চেষ্টা করব। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার একটি ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা খুব আলোড়িত হচ্ছে। এ যুগের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তাকে নিয়ে এক ভারতীয় তরুণীর মন্তব্যও আলোচিত হচ্ছে। তরুণী বলেছেন, ‘দেশের স্বার্থ নিয়ে লেখার জন্য কিভাবে নিজ দেশেরই লোক একটা ছেলেকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করে? কিভাবে এমন একটা দেশে মানুষ বাস করে!’
বহু মতে বিভক্ত এদেশের জনগণ (যা সাধারণত করে না) তরুণীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তার রাষ্ট্র নিয়ে সমালোচনা করে বাংলাদেশের উদারতার গল্প বলছেন। তরুণীর রাষ্ট্র ভারতে জয় শ্রীরাম না বলার অপরাধে হত্যা, গরুর অসম্মান হওয়ার অভিযোগে মানুষ হত্যা, সীমান্ত হত্যা, কাশ্মীর ইস্যুতে নিজ দেশের নাগরিকদের গৃহবন্দি করাসহ নানা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশিরা মন্তব্য করছেন। তারা বলতে বা বোঝাতে চেয়েছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ঢের উত্তম। অনলাইন মাধ্যমে বাংলাদেশিদের এমন মতৈক্য বিরল। আমার কাছে এর চেয়েও যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তা হলো ‘রাষ্ট্রের পবিত্র ধারণা’।
ভারত সফরে শেখ হাসিনা ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমার জন্য বাংলাদেশের জল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সাব্রুমের জল আর্সেনিক আক্রান্ত। এ জল খাওয়ার যোগ্য নয়। ভারত সরকার এ শহরের লোকদের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পানীয় জল প্রার্থনা করেছেন। ‘জল’ শব্দটি বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বহু বছর ধরে বাংলাদেশ গঙ্গা, তিস্তা, সুরমাসহ বিভিন্ন নদীর জলের হিস্যা চেয়ে এসেছে। ভারত তা কখনও দিয়েছে, কখনও দেয়নি। এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। তাদের ধারণা, ত্রিপুরার জন্য জল না দিলে মধুরতম প্রতিশোধ হতো।
সাব্রুমে বসবাসরত দশ হাজার লোক নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলা ভারতীয় নাগরিক। এই ভারতীয়দের বাঁচাতে বাংলাদেশ উদারতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বিরোধীদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন ‘কেউ খাওয়ার পানি চাইলে তো না দিয়ে থাকতে পারি না’। এটিই বাংলাদেশ।
হাজার বছর টিকে থাক বাংলাদেশ…
বাংলাদেশ দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ভারতের কাছে পানি চেয়েও পায়নি। বাংলাদেশের বহু জায়গা জলের অভাবে বিরাণ হয়েছে। চাষাবাদের অযোগ্য হয়েছে। ফসল নষ্ট হয়েছে। জল থাকলে আরও কিছু মানুষ খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারত।তবে এ সংখ্যাটা দশ হাজার নয়। কোটির উপরে। বাংলাদেশ জলের অভাব জানে। ভারত কখনও সময় চেয়েছে, কখনও পশ্চিমবঙ্গের মমতার দোহাই দিয়ে নির্মম হয়েছে। নিষ্ঠুরতা করেছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সাব্রুমের নাগরিকদের জন্য নদীর সাথে সাথে হৃদয়ের বাঁধ খুলে দিয়েছে। ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’
বাংলাদেশ প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী লালন-পালন করছে। তারা সবাই মারা পড়ত। যে ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে সে সময়টা বাংলাদেশের জন্য সোনায় সোহাগা বা সুখের ছিল তা কিন্তু নয়। উন্নয়নের দিক থেকে দ্রুত অগ্রগামী সংগ্রামী জাতি হিসেবে বাংলাদেশ তখনও লড়েছে। ১৯৭১ সালের সংগ্রামে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পরিচিত ভারতকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ পাশে চেয়েছিল। খুব নিষ্ঠুরতার সাথে ভারত এ নাজুক সময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। ভারত তার দেশে খুব কম সংখ্যক আশ্রিত রোহিঙ্গাকেও ঝেটিয়ে বিদায় করেছে। বাংলাদেশে পুশইন করতে চেয়েছে। মিয়ানমারের সুরে ভারত এদের রোহিঙ্গা বলতে অস্বীকার করেছে। একই সময়ে তারা মিয়ানমারের সাথে বিভিন্ন সামরিক চুক্তিও করেছে।
নিকট অতীতে বাংলাদেশের হৃদয়ে অনেক ঘা হয়েছে। কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্র ভারত কখনও তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। বাংলাদেশ বলতে পারত, তোমরা সীমান্তে মানুষ মারো; তোমরা আমাদের জল দাওনি; তোমরা তোমাদের আকাশ আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য রুদ্ধ করে রেখেছো। তোমাদের মন্ত্রী, পাইক-পেয়াদারা এনআরসির নামে প্রতিদিন বাংলাদেশকে হুমকি দেয়। বাংলাদেশ এসব কিছুই না বলে কিছু লোককে বাঁচানো পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা যে রাষ্ট্রের আশ্রয়ে, সেই রাষ্ট্রের কাছে পাশের দেশের দশ হাজার লোকের জন্য পানির জোগান দেওয়া তো কিছুই না।
রাষ্ট্র হয় মমতাময়ী মায়ের মতো। রাষ্ট্রের কাছে নিজের সন্তানরা যেমন নিরাপদ থাকবে, অন্য মায়ের সন্তানরাও তেমন মমতা দেখবে। বিপদে তাকেও মা ডাকতে পারবে। বাংলাদেশ তেমনই একটি রাষ্ট্র; নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের দর্শন চিন্তার পবিত্র রাষ্ট্র।
লেখক: মনোয়ার রুবেল, ফ্রিল্যান্স রাইটার
ইমেইল: [email protected]