ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে চায় ফারহাতুল
১৭ অক্টোবর ২০১৯ ০৯:২৮
দু’মাস বাদে ১০ বছরে পা দেবে ফারহাতুল মাহমুদ হাসান। বয়সের তুলনায় শান্ত চোখ। কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় মেপে। বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সে। কিন্তু গত তিন বছরে স্কুল, পড়ালেখা, খেলাধুলা নয়, বরং তার সময় কেটেছে হাসপাতালের বিছানাতে। তাই যেন স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছে ফারহাতুল। যখন জিজ্ঞাসা করলাম, বড় হয়ে কী হতে চাও?, কম্পিউটারে গেমস খেলতে ব্যস্ত ফারহাতুল মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই বললো, ‘এখনও ভেবে দেখিনি।’
তিন বছর ধরে মরণব্যাধি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত ফারহাতুল। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে প্রায় আড়াই বছর ধরে চলছে চিকিৎসা। খরচ হয়ে গেছে দেড় কোটি টাকারও বেশি। আগামী মাসে বোনম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্টের জন্য প্রয়োজন আরও প্রায় ৭০ লাখ টাকা, যা এখন ফারহাতুলের মা-বাবার পক্ষে জোগান দেওয়া সাধ্যের বাইরে। তাই সমাজের বিত্তবানসহ সহৃদয় ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান তাদের।
মাকে মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসা করে ফারহাতুল, ‘আম্মু, আমার কি অসুখ ভালো হবে না? আমি কি এভাবেই শেষ হয়ে যাব?’ বলতে বলতেই গলা ধরে আসে ফারহাতুলের মা শিউলি আখতারের। চোখ ভরে আসে জল। বুকে পাথর বেঁধে ছেলেকে বোঝান, অসুখ-বিসুখ হলে তার চিকিৎসা আছে। রোগ যত কঠিন হোক না কেন, তার চিকিৎসা আছে।
ফারহাতুলের বাবা এম ডি সাদেকুল ইসলাম পেশায় ব্যবসায়ী। গ্রামের বাড়ি রংপুর। বনশ্রীর ভাড়া বাসায় স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। ৯ বছর ১০ মাস বয়সের ফারহাতুল আর সাড়ে তিন বছরের ফারদিনকে নিয়ে হাসি-আনন্দে মেতে থাকার কথা তাদের। কিন্তু তাদের সব হাসি কেড়ে নিয়েছে জটিল এক রোগ।
চার বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে ফারহাতুলের। তখন রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, তার শরীরে রয়েছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসও। তখন থেকেই জটিল দুই রোগের জন্য শুরু হয় হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। এর মধ্যেই ক্লাস টুতে পড়ার সময় ফারহাতুলের ত্বকের রঙ ফ্যাকাসে হতে শুরু করে। মাঝেমধ্যে বমিও করতে থাকে সে।
সেসময় হেপাটাইটিস সি’র কারণে ফারহাতুলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। জটিলতা বাড়ায় চিকিৎসকদের পরামর্শে ভারতে নিয়ে ডিএনএ টেস্ট করা হয় তার। রেফার্ড করা হয় চেন্নাইয়ের খ্রিষ্টান মেডিকেলে। ধরা পড়ে একইসঙ্গে তিনটি জটিল রোগ— হেপাটাইটিস সি, ই বিটা থ্যালাসেমিয়া ও অ্যাকিউট মোনোব্লাস্টিক লিউকোমিয়া (Acute monoblastic leukemia)। দিনে তখন আট থেকে ১০ ব্যাগ করে রক্ত লাগত। সে যাত্রায় টানা ২৩ দিন চেন্নাইয়ে থাকতে হয় তাদের। প্রায় একমাস পরে দেখা যায়, হেপাটাইটিস সি জটিলতা ধারণ করে লিভার ক্যানসারে রূপ নেওয়ার দিকে মোড় নিয়েছে।
খ্রিষ্টান মেডিকেলের চিকিৎসকরা তখন জানান হেপাটাইটিস সি’র চিকিৎসা ১২ বছর হওয়ার আগে শুরু করার উপায় নেই। অথচ বাচ্চার বয়স তখন মাত্র আট। তখন খ্রিষ্টান মেডিকেলের এক চিকিৎসক সাদেকুলকে জানান, চেন্নাইর অ্যাপোলো হাসপাতালে আমেরিকা থেকে একজন চিকিৎসক এসেছেন, যিনি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ। ছেলেকে নিয়ে সেখানে ছুটে যান সাদেকুল। ডা. রেভাথি রাজের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা শুরু হয় ফারহাতুলের। তখন তার গায়ে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। চিকিৎসকদের জরুরি বোর্ড বসিয়ে পরীক্ষা শুরু হয় ফারহাতুলের। তাৎক্ষণিক পরীক্ষার পর জানানো হয়, সব পরীক্ষা ভারতে সম্ভব না। কিছু পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্র থেকে করিয়ে আনতে হবে।
https://youtu.be/2KCidqM7bZ0
সেই অনুযায়ী নিউইয়র্ক থেকে রক্ত পরীক্ষার ডায়াগনোসিস আসার পর চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু ফারহাতুলের মা-বাবাকে আগেই জানানো হয়, চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তারা যদি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হন, তবেই চিকিৎসা শুরু করবেন তারা। ২০১৮ সালের মার্চের ঘটনা। টানা দু’মাস চেন্নাই অ্যাপোলোতে চিকিৎসা চলে সে যাত্রা।
এতদিন হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আক্রান্ত থাকার কারণে বোনম্যারো ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট সম্ভব হচ্ছিল না ফারহাতুলের। তাছাড়া, ক্যানসারের কারণে ফারহাতুলকে নিয়মিত হোয়াইট সেল সরবরাহ করতে হতো। কয়েক মাস হলো হোয়াইট সেলের প্রয়োজন হচ্ছে না তার। তবে মাঝেমধ্যে বমি করে ফারহাতুল। এখন চিকিৎসকরা যত দ্রুতসম্ভব বোনম্যারো ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করে ফেলতে চান। বোনম্যারো নেওয়া হবে ফারহাতুলের বাবা সাদেকুলের থেকে।
এর মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই আছেন ফারহাতুলের মা-বাবা। গত প্রায় তিন বছরে সাদেকুলের নিজস্ব সঞ্চয়, আত্মীয়দের সাহায্য, ফারহাতুলের স্কুল বনশ্রী আইডিয়ালসহ নানা প্রতিষ্ঠানের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে চলেছে ফারহাতুলের চিকিৎসা। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়া হয়। সেখান থেকেও কিছু সাহায্য পেয়েছিলেন তারা। সবমিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এখন বোনম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্টের জন্য প্রয়োজন আরও ৭০ লাখ টাকা।
সাদেকুল জানান, শুধু হাসপাতালেই দিতে হবে ৪০ লাখ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে প্রয়োজন আরও ৩০ লাখ। অপারেশনের পর অন্তত ছয় মাস ভারতে থাকতে হবে সাদেকুলের পরিবারকে। সেটা হয়তো গড়াবে এক বছরে। ছেলেকে নিয়ে তিন বছরের এই দৌড়াদৌড়িতে নিজের ব্যবসাতেও সময় দিতে পারছেন না সাদেকুল। ভাগ্নের ওপর দিয়েছেন দেখাশোনার ভার।
আর এদিকে অসুস্থ ছেলের দেখাশোনাই শুধু নয়, ছেলেকে মানসিকভাবে সাহসও জোগাতে হয় তাকে। ফারহাতুলের খাবার-দাবারে রয়েছে বেশ রেস্ট্রিকশন। সেসব মেনে চলেন অক্ষরে অক্ষরে। ছেলের যেসব খাবার খাওয়া বারণ, সেসব বাজার আসে না তাদের বাড়িতে।
মা শিউলি আখতার জানালেন, তিন বছরের এই সংগ্রাম সম্ভব হতো না যদি না ছেলে পূর্ণ সহযোগিতা করত। তিনি বলেন, এত ছোট বাচ্চার কোনো বায়না নেই, আলাদা চাহিদা নেই। ছোটবেলা থেকেই শান্ত ফারহাতুল। যথেষ্ট মেধাবী ও সংবেদনশীল। ভালোবাসে খেলাধুলা। বিকেলে খেলতে যায় বন্ধুদের সঙ্গে। বাসায় আত্মীয়-বন্ধুরা আসলে সবচেয়ে খুশি হয় মিশুক স্বভাবের ফারহাতুল।
অন্যের শিশুদের স্কুলে যেতে দেখে বুক ভেঙে আসে শিউলির। বলেন, তিন বছর ধরে অসুস্থতার জন্য নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না ফারহাতুল। বাসায় নিজে পড়ান, আর একজন গৃহশিক্ষক এসে পড়িয়ে যান। ছেলে শুধু স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দেয়। অনেকসময় তাও পারে না। কিন্তু স্কুল থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পায় সে। এই তিন বছরে প্রমোশনও পেয়েছে নিয়মিত।
শিউলি বলেন, ছেলে পড়ালেখা করে বড় হয়ে কী হবে, সেটা পরের প্রশ্ন; ছেলেটা বেঁচে থাকুক, সুস্থ থাকুক— এর চেয়ে বড় আর কোনো চাওয়ার তার নেই।