Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কালের সাক্ষী শশী লজ


১৮ অক্টোবর ২০১৯ ০৮:১০

ময়মনসিংহ: কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ ভারতে পূর্ববাংলার সবচেয়ে ধনাঢ্য জমিদারের কীর্তি ময়মনসিংহের শশী লজ। তৎকালীন বিশ্বখ্যাত স্থাপত্য শৈলীতে এখানকার জমিদারদের নির্মিত এ শশী লজ ঘিরে প্রজা পীড়ন, প্রজা বাৎসল্য, অতিথি সেবা, কর্মময়তা প্রভৃতির নানা গল্প ছড়িয়ে আছে মানুষের মুখে মুখে।

বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী টিভি নাটক অয়োময় এর চিত্রায়ন হয় পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে জমিদারদের রেখে যাওয়া এই শশী লজে। সেই অয়োময় নাটকের শুটিং স্পট শশী লজ সম্পর্কে জানতে গিয়ে কালের ধূলো ঝেড়ে অতীত ইতিহাসের পাতা উল্টালে চোখে পড়ে- মুক্তাগাছার জমিদারদের কথা।

বিজ্ঞাপন

এখানকার জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরীর কোনো সন্তান ছিল না। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চলমান সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, সম্পত্তি সংরক্ষণে সক্ষম পুত্র সন্তানের অপরিহার্যতা অনস্বিকার্য। কী করা যায়? জীবনের জটিল অঙ্ক কষতে কষতে জমিদারদের পরিবারের রীতি অনুযায়ী দত্তক পুত্র গ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হন জমিদার।

গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিয়ে তার ওপর জমিদারীর দায়িত্ব অর্পণ করে পরপারে পাড়ি জমান রঘুনন্দন। জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীও নিঃসন্তান অবস্থায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন। গৌরীকান্তের বিধবা পত্মী বিমলা দেবী দত্তক নেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তেও দীর্ঘ রোগ যন্ত্রণায় ভুগে পরলোকগমন করেন অকালে। তার বিধবা পত্মী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরাণী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নেন চন্দ্রকান্তকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত ত্যাগ করলেন ভব মায়া।

বিজ্ঞাপন

তবে হাল না ছেড়ে লক্ষ্মী দেবী দ্বিতীয় দত্তক নেন পূর্ণচন্দ্রকে। কুলগুরুর যাবতীয় অর্চনায় মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী স্বীয় জমিদার বংশের সাথে মিল রেখে দত্তক পুত্রের নতুন নাম রাখেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।

সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। তার দক্ষতা, বীরত্ব গাথার সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত হয় জমিদারিও। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা।

ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে ৯ একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণে হাত দেন সূর্যকান্ত। নাম রাখেন শশী লজ। বিখ্যাত এ ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯০৫ সালে ঠিক একইস্থানে নতুনভাবে শশী লজ নির্মাণ করেন তারই পুত্র পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী।

১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্য বর্ধনে তিনি অপরুপ শৈলীতে সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কার কাজ। নবীন জমিদারের প্রাণান্ত প্রয়াসে শশী লজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর, অপরূপ। পুরাকীর্তির নিদর্শন প্রাচীন এই ভবনের রূপ-সৌন্দর্য অটুট আছে কি আজও, না হলে কী অবস্থায় আছে দেখে আসলে বুঝতে পারবেন অনায়াসে। সময়ের পালাবদলে ব্রিটিশ বিতাড়িত হয়েছে। বিলুপ্ত হয়েছে জমিদারি প্রথা। স্ববংশে জমিদাররা পাড়ি জমিয়েছেন ওপাড়ে। কিন্তু রেখে গেছেন তাদের সেই কর্ম।

কালের করালগ্রাসে শশী লজ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে বিনষ্ট করেছে ভবনটির ভৌত অবকাঠামোকে। ১৯৫২ সাল থেকে শশী লজ ব্যবহৃত হচ্ছে মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হিসেবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের শত ক্ষত নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি।

মূল শহরে দৃষ্টি ফেললে উদ্ভাসিত হয় উঁচু দেয়ালঘেরা শশী লজের প্রবেশদ্বার। ভেতরে প্রবেশ করলেই শান বাঁধানো প্রবেশ পথের সামনেই শশী লজের সাজানো বাগান। বিচিত্র প্রজাতির ফুলশোভিত সেই বাগানের মধ্যভাগে বৃত্তাকার জলফোয়ারা। ফোয়ারা কেন্দ্রে অনুচ্চ বেদির ওপর দণ্ডায়মাণ গ্রিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত স্বল্পবসনা নারী মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ। সুপ্রাচীন এই ভবনের পূর্বপ্রান্তের ঘরটি বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে কলেজ অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে। বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রাম ঘর। বিশ্রাম ঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো স্ফটিকস্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি।

রয়েছে বহু কক্ষ। পরিচর্যাহীন, ধুলোমলিন সেই কক্ষগুলোর কোনোটি তালাবদ্ধ, কোনোটি নানা রকম অশোভনীয় আসবাবে ঠাসা। ভবনটির পেছনে এক চিলতে উঠোন। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠোন পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পারে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির মনকারা সৌন্দর্য আপনাকে বিমোহিত না করে পারেই না। ভ্রমণপিপাসু মনকে শান্ত করতে ক্ষনিকের জন্য হলেও আপনি অনায়াসে ঘুরে যেতে পারেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার সবচেয়ে ধনাঢ্য জমিদার মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর মনের মাধুরী মিশিয়ে নির্মিত বিলাশ বহুল ভবন কিংবা অমর কথাশিল্পি হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী অয়োময় নাটকের সেলুলয়েডের পাতায় বন্দি সেই কল্পিত জমিদার মীর্জা সাহেবের বাড়ি শশী লজে। এক সময় অঢেল জায়গা নিয়ে অবস্থিত শশী লজের চারদিকে দৃষ্টিনন্দন ফুলবাগান ছিল, ছিল বিভিন্ন বৃক্ষবীথি।

সময়ের প্রয়োজনে মূল স্থাপনার সাংঘর্ষিক নানা স্থাপনা নির্মাণের ফলে ঐতিহাসিক এ ভবন ও তার পারিপার্শিব ফুল-বৃক্ষবীথির সৌন্দর্যে কিছুটা বেখাপ্পার ছাপ লাগলেও শশী লজের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম।

সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ ভবনটিকে পুরাতত্ত্ব হিসেবে চিহিৃত করে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরে সংযোজন করেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের স্থানীয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খুব দ্রুতই শশী লশের সংস্কার কাজ করা হবে। আদল ঠিক রেখে এটিকে পর্যটক আকর্ষণীয় করে তোলা হবে। দর্শনীর মাধ্যমে প্রদর্শনের ব্যবস্থাও করা হবে। সরকারের সুদৃষ্টির প্রসারণে পুরাতন আদল ঠিক রেখে নবসংকরণে শশী লজ টিকে থেকে অতীতের পাঠ শিক্ষা দিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এমনই প্রত্যাশা।

যেভাবে যাবেন

ঢাকার যেখান থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার বাস পাবেন। সেখান থেকেই বাসে উঠে ময়মনসিংহ শজরে নামবেন। সেখান থেকে ইজিবাইক বা যে কোনো রিকশায় অতি সহজেই শশী লজ বা ময়মনসিংহ রাজবাড়ী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কথা বলে কয়েক মিনিটেই যেতে পারবেন। রিকশায় ওঠার সময় দরদাম করে ভাড়া ঠিক করে নিতে ভুলবেন না।

শশী লজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর