ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্ষমতা বাড়াচ্ছে ‘মেডিকেল মিশন’
১৮ অক্টোবর ২০১৯ ২২:৩৫
ঢাকা: বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একটি দুরারোগ্য রোগ হিসেবে পরিচিত ক্যানসার। বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তবে আশার কথা হলো, দুরারোগ্য হলেও সময়ের পালাবদলে এখন ক্যানসারের চিকিৎসা দুর্লভ নয়। বাংলাদেশে এখন ক্যানসার মানেই কিন্তু মৃত্যুর প্রহর গোনা নয় বরং চেষ্টা করে যাওয়া দুরারোগ্য এই রোগের বিপক্ষে জয়ী হয়ে ওঠার।
আর সেজন্যে সরকারি উদ্যোগেই এখন দেশের হাসপাতালগুলোতে সীমিত পরিসরেও দেওয়া হচ্ছে ক্যানসারের চিকিৎসা। তবে এ ক্ষেত্রে মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল দিয়ে যাচ্ছে বিশেষায়িত সেবা। এই সেবা সক্ষমতা বাড়াতেই গত তিন বছর ধরে দেশের চিকিৎসক-নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে ‘ক্যানসার মেডিকেল মিশন’। ১০ জন ক্যানসার বিশেষজ্ঞের একটি প্রতিনিধি দল চলতি অক্টোবরে দেশে পঞ্চমবারের মতো এসেছেন একই উদ্দেশে।
গত শনিবার (১২ অক্টোবর) থেকে টানা তৃতীয় বছরের মতো ‘পার্টনার্স ফর ওয়ার্ল্ড হেলথ’র সহযোগিতায় বাংলাদেশে তৃতীয়বারের মতো ক্যান্সার মেডিকেল মিশনের কার্যক্রম চলছে। ক্যানাসারের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের রোগীদের আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবার সঙ্গে পরিচয় করাতে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের চিকিৎসক ও নার্সদের ক্যান্সার চিকিৎসার আধুনিক ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করাতে এই কার্যক্রমের আয়োজন করেছে রোটারি ক্লাব অব ঢাকা ম্যাভেরিক্স।
১০ সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্বে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের এলিজাবেথ ম্যাকলিলান। তিনি পার্টনার্স ফর ওয়ার্ল্ড হেলথ নামের একটি সংগঠন পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাদেশে ২০১২ থেকেই তিনি আসেন। এবারও তার নেতৃত্বেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নার্সরা কাজ করে যাচ্ছেন। দলে রয়েছেন সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট ডা. সুজান আলিসা হুকস্ট্রা, সার্জিকাল অনকোলজিস্ট ডা. রাজা আগজাদি, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ডা. আরুল মাহাদেবান, মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট ডা. সাবরিনা খান, মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট ডা. হামিদ লারি, রেজিস্টার্ড নার্স জুলিয়েট কোহেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার নার্স মার্জোরি ডুগ্যান স্কুনোভার, ফিজিওথেরাপিস্ট পেইন ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ মেরি বার্গ। দলের সঙ্গে থাকা রোনাল্ড কোহেন একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এসেছেন এই দলের সঙ্গেই।
আগের বছরগুলোর মতো এবারও চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে নিয়ে ক্যান্সার রোগ বিষয়ক অভিজ্ঞতা বিনিময়, প্রশিক্ষণ, জয়েন্ট সার্জারিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছেন তারা। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী দেখছেন এবং একই সঙ্গে কথা বলছেন রোগীর স্বজনদের সঙ্গেও। আলাদাভাবে নার্সদের জন্য করানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। যেখানে উন্নত দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে নিজেদের শানিত করছেন রোগীদের সেবায় নিয়োজিত থাকা নার্সরা
এলিজাবেথের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেলো বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসার কথা। এই দেশের মানুষকে এখন তিনি নিজের পরিবারের মানুষ বলেই ভাবেন। বাংলাদেশকেও ভাবেন নিজের দেশ হিসেবে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে অসংক্রামক রোগের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে রোগ নিয়ে ভীতিও। একই সঙ্গে ক্যানসার চিকিৎসা যেহেতু ব্যয়বহুল তাই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে রোগী এবং তার স্বজনেরা অনেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। আর এক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়ায় রোগীর সেবা দেওয়া না গেলে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা যায়। যথাযথ চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজন হয় কাউন্সিলিংয়ের। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারদের পাশাপাশি হাসপাতালের নার্সদের একটা বিশাল ভূমিকা রাখতে হয়। আর তাই তাদের নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয় বরং অন্যান্য স্থানেও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি করানো হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধরণের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের প্রতি নিজের ভালোবাসা থেকে ভবিষ্যতেও তিনি কাজ করে যাবেন বলে জানান।
দলের সঙ্গে এসেছেব রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ডা. আরুল মাহাদেবান। সারাবাংলার পক্ষ থেকে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পরবর্তীতে কোনো উন্নতি দেখতে পাচ্ছেন কিনা? তিনি বলেন, ‘ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাতারাতি কোনো কিছুই সম্ভব নয়। একটা সিস্টেম গড়ে তোলা প্রয়োজন এই রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থায়। সেই সিস্টেম গড়ে তোলার কাজে আমরা সাহায্য করে যাচ্ছি। অবশ্যই উন্নতি অনেক হয়েছে, আরও হবে। আগে বাংলাদেশের খুব কম হাসপাতালে প্যালিয়াটিভ কেয়ার ছিল। এখন গড়ে উঠছে। ক্যানসার ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে এখন গড়ে উঠেছে প্যালিয়াটিভ কেয়ার। এটা খুবই জরুরি। আর এভাবে আমরা আশা করছি অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসবে।’
মহাখালী ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়ারফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু একটি সেক্টর এগোলে হবে না, সব সেক্টরকেই সমানভাবে এগুতে হবে। এই ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যখাতকেও এগিয়ে নিতে হবে আমাদেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। রোটারি ক্লাব অব ঢাকা ম্যাভেরিক্সের উদ্যোগে যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আসছেন তারা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের এখানে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্সরা ওনাদের সঙ্গে থেকে নিজেদের কর্মদক্ষতা ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে যেকোনো হাসপাতালে নার্সদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায়। আমাদের ক্যানসার ইনস্টিটিউটে যেসব নার্সরা কাজ করে তারা সবাই অভিজ্ঞ। তারাও এই বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। রোগীর ও তাদের আত্মীয় স্বজনের কাউন্সিলিংটা খুবই জরুরি। বিদেশে যেভাবে এই কাউন্সিলিং করা হয় সেটা ওনারা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করছেন, আর এটাকে আমি একটা বিশাল প্রাপ্তি হিসেবেই দেখি।’
দলের সঙ্গেই ছিলেন বাঙ্গালি শামস রশিদ জয় ও সুস্মিতা খান দম্পতি। তাদের কাছ থেকেই জানা গেলো এক বিশাল কর্মযজ্ঞের গল্প যা অনেকটা নীরবেই চলছে মানবসেবার ব্রত নিয়ে।
রোটারি ক্লাব অব ঢাকা ম্যাভেরিক্সের পুষ্টিবিদ সুষ্মিতা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত তিন বছরে আমাদের এই কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার ১০০ নার্স ও ৬০০ চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সার বিষয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।’
রোটারি ক্লাব অব ঢাকা ম্যাভেরিক্সের শামস রাশীদ জয় সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের মানুষের জন্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও করে যাবো।’
আন্তর্জাতিক ক্যানসার মেডিক্যাল মিশন ক্যানসার ক্যানসার চিকিৎসা