Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা: একদিনে শুধু পঙ্গুতেই ভর্তি ১৬৭ জন


২২ অক্টোবর ২০১৯ ২০:১৫

ঢাকা: রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারে গত বুধবার (১৬ অক্টোবর) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কামরুজ্জামান আসিফ (২৪) নামে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ওই মোটরসাইকেলের আরোহী তার দুই বন্ধু গুরুতর আহত হন।

ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ জানান, রাতে তিন জন এক মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আইল্যান্ডের সঙ্গে ধাক্কা খায়। তাদের হাসপাতালে নেওয়ার পর আসিফ মারা যান। বাকি দু’জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভর্তি করা হয়।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২১ অক্টোবর) পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত নিটোরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরেজমিনে এই প্রতিবেদকের কথা হয় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে। রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে এসেছেন এসব রোগী।

হাসপাতালটির চার তলার পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি মাদারীপুরের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাগর। তার স্বজনরা জানান, গত সপ্তাহে মোটরসাইকেলে চড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়ে মাদারীপুর হাইওয়েতে দুর্ঘটনা শিকার হয় সাগর ও তার দুই বন্ধু। তিন জনের মধ্যে সাগরে অবস্থা গুরুতর। তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আরও একটি অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হচ্ছে না।

সাগরের পাশের বেডে ভর্তি আছেন মো. আরমান মাহমুদ সোহেল (৩০)। পেশায় ব্যবসায়ী। ঢাকা-ময়মসিংহ হাইওয়েতে বাইক চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত আরমানের একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। গত ১৯ দিন ধরে চিকিৎসাধীন আরমান প্রাণে বেঁচে গেলেও পা কাটা পড়ায় মানসিকভাবে ভীষণ রকম বির্পযস্ত।

বিজ্ঞাপন

একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন গোপালগঞ্জের মিরাজ হোসেন রুদ্র (২৪)। নিজেই বাইক চালিয়ে মহাসড়কে ওঠার পরপরই আরেকটি বাইকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে প্রাণে বেঁচে গেলেও হাসপাতালের বিছনায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন গত ২১ দিন ধরে।

এই হাসপাতালের বহির্বিভাগেও দেখা যায় প্রায় একই রকম দৃশ্য। শুধু রাজধানীই নয়, বরং দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত অনেকেই ভিড় করেছেন জরুরি সেবা নিতে।

সোমবার দুপুর ২টা নাগাদ একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ছেলেকে নিয়ে আসেন বাবা সবুর মিয়া। পেশায়  রিকশাচালক সবুর জানান, ছেলে সবুজ বাইকে চড়ে মহাখালী আসছিলেন। পথে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকেই ছেলেকে নিয়ে এসেছেন পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। চিকিৎসকরা তার ছেলের রক্তক্ষরণ বন্ধ করেছেন, পরামর্শে নিয়েছেন হাসপাতালে ভর্তি করাতে।

জরুরি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আঁখি বেগম সারাবাংলাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে প্রতিদিন রোগী আসেন। আমরা দৈনিক যে পরিমাণ রোগী পাই, তার ৮০ থেকে ৯০ ভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।

নিটোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২১ অক্টোবর হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেন ২০৫ জন রোগী, যা একদিনের হিসাবে এই বছরের সর্বোচ্চ। এই ২০৫ জনের মধ্যে ১৬৭ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।

আঁখি বেগম জানান, সাধারণত প্রতিদিন ১৬০ থেকে ১৭০ জন রোগী আসেন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে। এর মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। সোমবারও সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে অবস্থান করে দেখা যায়, এই ছয় ঘণ্টায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ৩৭ জন গুরুতর আহত ব্যক্তি জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তাদের প্রায় সবাই  তরুণ।

জানতে চাইলে পঙ্গু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আজকাল অনেক বাইকারকেই দেখা যায় সর্বোচ্চ গতিতে সড়কে গাড়ি চালাতে। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতেও। আর এমন পরিস্থিতিতে সড়ক দুর্ঘটনার হারও বেড়ে চলেছে।

তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের  বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগের অধিকাংশ ঘটনাই আজকাল সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যেগুলোর বেশিরভাগই আবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সড়কে গতি কমানো ছাড়া আপাতত কোনো সমাধান দেখছেন না এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও। একইসঙ্গে চালকদের গতিনিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের আরও জোরালো ভূমিকা আশা করেন তিনি।

সেফ রোডস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্সের (SROTA) বিশেষজ্ঞ সদরুল হাসান মজুমদার বলেন, রাজধানীতে মানুষ সময় বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন বাইক সার্ভিস কোম্পানির ওপর ভরসা করার পাশাপাশি নিজেরাও বাইক কিনছে। অনেক তরুণ পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন মোটরসাইকেল চালানোকে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণের কর্মসংস্থানও হয়েছে এর মাধ্যমে। এটা বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু এ বিষয়ে খুব শিগগিরই একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার। ক্রমবর্ধমান এই খাতকে এখন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মধ্যে আনতে দরকার প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স যাচাইসহ বাইকারদের জন্য আলাদা লেনের মতো কিছু বিষয়।

বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য বাইক সার্ভিস ইতিবাচক হলেও এটার জন্য সরকারের কোনো মনিটিরিং সেল নেই। বিভিন্ন কোম্পানির সস্তা কিস্তিতে বাইক বিক্রিতে সরকারি নজরদারি দরকার বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

সদরুল হাসান মজুমদার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক নিরাপত্তা আইন পাসের একবছর পরও তা কার্যকর হয়নি। আমরা যেন ভুলেই গেছি সড়ক নিরাপত্তা আইনের বিষয়টি। আইন পাসের একবছর হলেও এখনো আইনের বিধি প্রণয়ণ করা হয়নি। এটাকে বাস্তবায়নের কোনো প্রস্ততিই নেই। আইন কার্যকর না করে ভিন্ন উদ্যোগ সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ আরও দীর্ঘায়িত করে তুলবে বলেও মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ।

রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং

২০১৬ সালে বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে আসে উবার। প্রথমে কেবল ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে সেবাদান শুরু করলেও পরে এই সেবায় যুক্ত হয় মোটরসাইকেল। প্রায় একই সময়ে ঢাকার রাস্তায় সেবা দিতে শুরু করে পাঠাও, সহজ, ওভাই, ওবোন, স্যাম, বাহন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালে ৫৩ হাজার ৭৩৮টি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে নিবন্ধিত হয় ৭৫ হাজার ২৫১টি মোটরসাইকেল। ২০১৮ থেকে চলতি বছরের এ পর্যন্ত মোটরসাইকেলের নিবন্ধন হয়েছে এক লাখের কাছাকাছি। এছাড়াও রাজধানীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছেন মোটরসাইকেল চালকেরা। সবকিছু মিলিয়ে রাজধানীতে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে সড়ক দুর্ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনা থেকে বাদ যাচ্ছে না রাইড শেয়ারিংয়ের চালক ও যাত্রীরাও।

২০১৮ সালের ৫ জুলাই বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় বিআরটিসির দোতলা বাসের ধাক্কায় পাঠাও আরোহী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাজমুল হাসানের (৩২) মৃত্যু হয়। একই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মতিঝিলে পাঠাওয়ের মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী দু’জনই মারা যান লরির ধাক্কায়। ২০১৮ সালেরই ১৭ সেপ্টেম্বর খিলক্ষেতে লা মেরিডিয়ান হোটেলের বিপরীত সড়কে মারা যান পাঠাও আরোহী লাফিজুর রহমান (৫০)। এ বছর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহমিদা হক রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে মোটরসাইকেলে চড়ে যাওয়ার সময় কার্ভাডভ্যানের ধাক্কায় মারা যান।

নিটোর পঙ্গু হাসপাতাল মোটরসাইকেল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রাইড-শেয়ারিং সড়ক দুর্ঘটনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর