সারা ঢাকায় সেবা ছড়িয়ে দিতে চায় জো-বাইক
২৪ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:৫৬
ঢাকা: বাইসাইকেল বা দ্বি-চক্রযান বর্তমানে সহজ, জ্বালানিমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যদিও যন্ত্রচালিত যানবাহনের চাপে এই বাহনটি প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। ইতিহাসের বিবর্তনে আবার ফিরে এসেছে বাইসাইকেল। বিশ্বের অন্যান্য সিটির মতো ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়ও এর জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এরই মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের দুটি এলাকায় অ্যাপভিত্তিক বাইসাইকেল সেবা চালু করেছে ‘জো-বাইক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে এখন পুরো ঢাকাতেই তাদের সেবা সম্প্রসারণ করতে চায়। প্রাথমিকভাবে গুলশান, বনানী ও উত্তরায় ‘জো-বাইক’ সার্ভিস চালুর লক্ষ্য রয়েছে তাদের। ধীরে ধীরে তারা এই সেবাটি পুরো শহরেই ছড়িয়ে দিতে চায়। প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সারাবাংলাকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ২০টি বাইসাইকেল দিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘জো-বাইক’। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবাটি চালু হলে তারা আলোচনায় আসে। আর সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হলে শিক্ষার্থীদের কাছে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যানজটের নগরী ঢাকার অনেক বাসিন্দাকেই জোবাইক নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেত দেখা গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার ও মিরপুর ডিওএইচএসে জো-বাইক সার্ভিস চালু রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জো-বাইক সার্ভিস চালু হলেও আপতত তা বন্ধ আছে। ডিসেম্বরে ফের জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে সেবাটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যায়ে জো-বাইকের কার্যক্রম চালুর লক্ষ্য রয়েছে। যানজটের নগরী ঢাকা শহরেও জোবাইকের কার্যক্রম শুরু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে গুলশান, বনানী ও উত্তরা প্রাথমিক তালিকায় রয়েছে।
জানতে চাইলে জো-বাইকের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মেহেদী রেজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমাদের কার্যক্রম ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক শুরু হলেও এখন আমরা পুরো ঢাকা শহরে যেতে চাচ্ছি। গুলশান, বনানী ও উত্তরায় সেবা চালু করার লক্ষ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাশের পর অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান মেহেদী রেজা। সেখান থেকে বিবিএ ডিগ্রি অর্জন করে ২০০২ সালে দেশে ফিরে আসেন। বহুজাতিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে মেহেদীর। এছাড়া নোকিয়া বাংলাদেশ, এশিয়াটিক, চ্যানেল আইয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আই ডিজিটাল এবং প্রশিকায়ও কাজ করেছে তিনি।
মেহেদী রেজা বলেন, ‘আলিবাবায় কাজ করার সময় অসংখ্যবার চীনে যেতে হয়েছে। সেখানে অ্যাপভিত্তিক বাইসাইকেল সেবা প্রচুর জনপ্রিয়। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই জো-বাইক নিয়ে কাজ শুরু করি। দুজন সহ-উদ্যোক্তা ও কয়েকজন বোর্ড মেম্বার রয়েছেন প্রতিষ্ঠানে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০টি বাইসাইকেল দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে আমাদের ৪০০ সাইকেল রয়েছে। নভেম্বরে আরও ১০০ সাইকেল আসার কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষের চাহিদা অনেক বেশি। সে তুলনায় আমাদের বিনিয়োগ কম। বড় বিনিয়োগ পেলে আমরা আরও বৃহৎ পরিসরে শুরু করতে চাই।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জোবাইকের কার্যক্রম বন্ধ থাকার বিষয়ে মেহেদী বলেন, ‘ক্যাম্পাসটিতে প্রচুর বাইসাইকেল নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ক্যম্পাসের বাইরের মানুষও চালাতে পারতো। অনেকে বাইসাইকেল চালানো শেষে পুকুর কিংবা ডোবায়ও ফেলে গেছে। তবে ডিসেম্বরে আমরা সেখানে আবারও যাত্রা শুরু করছি।’
পুরো ঢাকায় যাত্রা শুরু হলে সাইকেল চুরি যাওয়ার কোনো শঙ্কা আছে কিনা? জানতে চাইলে মেহেদী রেজা বলেন, ‘বাইসাইকেলগুলো চুরি হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকটি সাইকেলে জিপিএস ট্র্যাকার থাকবে। কোন সাইকেলটি কোন স্থানে আছে, চলন্ত না থেমে আছে তাও জানা যাবে। কেউ নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে চাইলে তাকে ফোন দিয়ে জানানো হবে, যেন এলাকার বাইরে না যায়। বারবার এমন করলে তাকে অ্যাপ থেকে ব্যান করে দেওয়া হবে।’
ঢাবি ক্যাম্পাসে জো-বাইকের ব্যাপক চাহিদা
যাত্রা শুরুর মাত্র চারদিনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে জো-বাইক ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভাড়ায় বাইসাইকেল পেতে প্রতিটি পার্কিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী এক থেকে দেড় ঘণ্টাও অপেক্ষা করছেন কাঙ্ক্ষিত বাইসাইকেল পেতে।
ঢাবির সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বষের শিক্ষার্থী জয়া মোদক সারাবাংলাকে বলেন, ‘জো-বাইক আসায় ক্যাম্পাসে যাতায়াত এখন সহজ হয়েছে। রিকশা ভাড়া কমেছে। সময় সাশ্রয় হচ্ছে। এখন মাত্র আট থেকে নয় টাকায় নীলক্ষেতসহ ক্যাম্পাসে যাতায়াত করা যাচ্ছে। আগে যেখানে খরচ হতো ৫০ থেকে ৬০ টাকা। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে এই সাইকেলে হর্ন না থাকা একটি বড় সমস্যা।’
সমাজ বিজ্ঞানের আরেক শিক্ষার্থী সোহাইব বলেন, ‘এক থেকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাইসাইকেল পাইনি। জো-বাইক নিয়ে সবার প্রচুর আগ্রহ। প্রথম কোনো জিনিসের প্রতি মানুষের যেমন আগ্রহ থাকে তেমন।’ আরেক শিক্ষার্থী নিশাত বলেন, ‘এক হল থেকে আরেক হলে যেতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা খরচ হতো। এখন তা ৫ থেকে ৬ টাকায় নেমে এসেছে। আবার নিজেই সাইকেল চালানোয় শরীরও সুস্থ থাকছে।’
জোবাইকের ঢাবি ক্যম্পাসের ইনচার্জ সেলিমুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। ১০০টি সাইকেল দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু চাহিদা অনেক। শিক্ষার্থীরাও বাইসাইকেল পেতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন। চার্জিং পয়েন্টে এসেও তারা সাইকেল খুঁজছেন। শিগগিরই ক্যাম্পাসে আরও সাইকেল বাড়ানো হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহায়তায় ঢাবি ক্যাম্পাসে জো-বাইক সার্ভিস চালু হয়েছে। এ বিষয়ে ডাকসুর ছাত্রপরিবহন সম্পাদক মো. শামস ই নোমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডাকসুর নির্বাচনের সময় আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ক্যাম্পাসে অ্যাপভিত্তিক বাইসাইকেল সেবা চালু করা হবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবাটি চালু করা হয়েছে। এটি চালু করতে পেরে ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই ভালো লাগছে। সেবাটি অল্প সময়ের মধ্যে ক্যম্পাসে তা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জোবাইকের ২৪টি পার্কিং স্টেশন রয়েছে। কর্মী রয়েছেন সাতজন। চালুর চারদিনেই তিন হাজার শিক্ষার্থী জো-বাইকে নিবন্ধন করেছেন। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি মেহেদী রেজা বলেন, ‘ঢাবির মতো ক্যাম্পাসে ১০০ বাইসাইকেল যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীরা এখন বাইসাইকেল নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অনেকে আবার তার বন্ধু বা বান্ধবীকে বাইসাইকেল চালানো শেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা এ সার্ভিস চালু করেছি শুধু যাতায়তের জন্য। যেহেতু অনেকেই সাইকেল চালানো শিখতে চাচ্ছে, তাই প্রতি শুক্রবার আমাদের বাইসাইকেল প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়া অল্প সময়ের মধ্যেই আরও ১০০ বাইসাইকেল ঢাবি ক্যাম্পাসে যুক্ত করা হবে।’
জো-বাইক দেশের প্রথম অ্যাপভিত্তিক বাইসাইকেল সেবা। ব্যবহারীকে প্রথমে গুগল প্লে-স্টোর থেকে জো-বাইক অ্যাপ তার মুঠোফোনে ইনস্টল করতে হয়। পরে রিফিল করে বাইসাইকেল ব্যবহার করা যায়। প্রথম ৫ মিনিট ২টা ৫০ পয়সা, পরবর্তী প্রতি মিনিটের জন্য ৪০ পয়সা খরচ পড়ে। ব্যবহারকারীরা কিউআর কোড স্ক্যান করে বাইকগুলো আনলক করে চালাতে পারেন। আর চালানো শেষে নির্দিষ্ট পয়েন্টে তা ম্যানুয়ালি লক করে রেখে দিতে হয়ে।