নুসরাত হত্যা মামলা: একনজরে ঘটনাপ্রবাহ
২৪ অক্টোবর ২০১৯ ০৯:১৮
এ বছরের নৃশংস ঘটনাগুলোর একটি ফেনীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে (১৮) আগুনে পুড়িয়ে হত্যা। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও তার সহযোগীরা এই হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। নুসরাতকে হত্যার সাড়ে ছয় মাসের মাথায় এই মামলার রায় ঘোষণা হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর)।
নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআইয়ের) ফেনীর পরিদর্শক মো. শাহ আলম মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন আদালতে। মামলার মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৮৭ জন। আদালতের কাছে আসামিরা নিজেদের দাবি করেছেন নির্দোষ হিসেবে।
এই মামলায় গত ১০ জুন অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার পর মাত্র ৬১ কার্যদিবসে রায়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৪ অক্টোবর।
নুসরাত হত্যা মামলার আসামিরা হলেন— সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামলীগের সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
এছাড়া, অধ্যক্ষের যৌন হয়রানির বিষয়ে থানায় নুসরাতের অভিযোগ গ্রহণের সময় তার ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনেরও বিচার চলছে। সাইবার আইনে দায়ের করা মামলাটিতে তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
আরও পড়ুন:- নুসরাত হত্যা মামলার রায় আজ
নুসরাত জাহান রাফিকে অধ্যক্ষের যৌন হয়রানি, পরে হত্যার উদ্দেশ্যে তার শরীরে আগুন দেওয়া থেকে শুরু করে রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হলো সংক্ষেপে—
১৭ মার্চ: মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ রুমে ডেকে নিয়ে নুসরাতকে যৌন হয়রানি করেন।
২৭ মার্চ: অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন নুসরাত। এদিনই সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২৮ মার্চ: স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইন্ধনে সিরাজ উদদৌলার সহযোগীরা তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করে।
৬ এপ্রিল: সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আলিম (এইচএসসি) পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদরাসাকেন্দ্রে যান নুসরাত। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে কয়েকজন বোরকা পরিহিত ব্যক্তি নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। অ্যাম্বুলেন্সে নুসরাতকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য আনার পথে তিনি পরিবারের কাছে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেন।
৭ এপ্রিল: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি নুসরাতের চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে সরকার। এদিকে মাদরাসার গভর্নিং কমিটির সভায় বরখাস্ত করা হয় অধ্যক্ষ সিরাজকে।
৮ এপ্রিল: দুপুর ১২টার দিকে নুসরাতকে বার্ন ইউনিটের লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। এরই মধ্যে হত্যাচেষ্টার অপরাধে আটক করা হয় নুরুল আমিন, আশরাফ, সাইফুল, আরিফসহ সাত জনকে। আট জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত চার জনকে আসামি করে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন নুসরাতের ভাই নোমান। উন্নত চিকিৎসার জন্য নুসরাতকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১০ এপ্রিল: অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সোনাগাজী থানার ওসি (তদন্ত) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কামাল উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। মামলা স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ইনভেস্টিগেটিভ ব্যুরোতে (পিবিআই)। এদিন লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় রাত সাড়ে ৯টায় মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।
১১ এপ্রিল: আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নুসরাত হত্যা মামলাটি প্রয়োজনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে। সন্ধ্যা ৬টায় সোনাগাজী আল হেলাল একাডেমির পাশে সামাজিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় নুসরাতকে।
১২ এপ্রিল: নুসরাতের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়ে সারাদেশে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। হত্যাকাণ্ডের ধিক্কার জানিয়ে জোরালো হয় বিচারের দাবি।
১৩ এপ্রিল: পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা জেল থেকে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
১৫ এপ্রিল: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান নুসরাতের বাবা একেএম মুসা ও মা শিরিনা আক্তারসহ দুই ভাই। প্রধানমন্ত্রী নুসরাতের পরিবারের প্রতি সান্ত্বনা ও গভীর সমবেদনা জানান। আশ্বাস দেন, অপরাধীরা কেউ ছাড় পাবে না।
এদিন আইন বহির্ভূতভাবে নুসরাতকে জেরা করে তার ভিডিও প্রচারের অভিযোগে বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
১৮ এপ্রিল: নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হাফেজ আবদুল কাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও ঘটনার লোহর্ষক বর্ণনা দেন।
২০ এপ্রিল: আসামি জাবেদ ও মনি ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জাবেদ বলেন, তিনি নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালেন। এরপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মনি জানান, নুসরাতকে ছাদে জোর করে শোয়ানোর পর তাকে চেপে ধরেছিলেন তিনি। এছাড়া, জাবেদ পরিচয় গোপন করার জন্য বোরকা পরে ছিলেন।
২৯ এপ্রিল: হত্যা মামলার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাদরাসার, শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও নুসরাতের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেন পিবিআই সদস্যরা।
৪ মে: পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জানান, হত্যার মামলার তদন্ত মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। কিছু কাগজপত্র তৈরি করে এ মাসেই (মে) আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।
৯ মে: নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে ২৭ মে তার বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা।
২৯ মে: সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাণদণ্ডের সুপারিশ করে মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দেয় পিবিআই। ৭২২ পৃষ্ঠার চার্জশিটের পাশাপাশি পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা পর্যন্ত ধাপগুলোর সচিত্র প্রতিবেদনও পিবিআই প্রকাশ করে।
৩০ মে: নুসরাত হত্যা মামলার ১৬ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়।
১০ জুন: ১৬ আসামির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া চার্জশিট আমলে নেন আদালত। একইসঙ্গে আদালত আসামিদের জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
১৬ জুন: দায়িত্বহীন আচরণের জন্য দোষী সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
৩০ জুলাই: ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে সাক্ষ্য দেন নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসাসহ চার জন। এদিন জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি পিপি হাফেজ আহাম্মদ ও বাদীর আইনজীবী শাহজাহান সাজু জানান, নুসরাত হত্যা মামলায় ৯২ সাক্ষীর মধ্যে বাদীসহ ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
৯ সেপ্টেম্বর: হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১৬ আসামি আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অধ্যক্ষ সিরাজসহ অভিযুক্ত ১৬ আসামির সবাই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
৩০ সেপ্টেম্বর: মামলায় দু’পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে এদিন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
২৪ অক্টোবর: বহুল আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার রায় আজ।
অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা নুসরাত হত্যা নুসরাত হত্যা মামলার রায় ফেনী