৫ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে চীন থেকে যুক্তরাজ্যে মানবপাচার
২৫ অক্টোবর ২০১৯ ১৮:১২
চীনে একটি প্রবাদ আছে— যদি পরিবারের একজন বিদেশ যায়, তাহলে পুরো পরিবার স্বচ্ছল হয়!
অর্থবিত্তে চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সম্মান পেলেও দেশটির গ্রামাঞ্চলে অন্তত ৩ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। আর তাই অধিক অর্থের লোভে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের অনেকেই পড়ছেন মানবপাচার চক্রের হাতে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের অ্যাসেক্সে মালবাহী লরিতে পাওয়া যায় ৩৯টি মরদেহ। পরবর্তীতে জানা যায় তারা সবাই চীনের নাগরিক। কোনো একটি মানবপাচার চক্র অবৈধভাবে ভুক্তভোগীদের যুক্তরাজ্যে আনার চেষ্টা করেছিল। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, চীন থেকে যুক্তরাজ্যে অন্তত ৫ হাজার মাইলের তিনটি ভিন্ন রুট ব্যবহার করা হয় মানবপাচারের জন্য। এই রুটগুলো হলো সাইবেরিয়ান রুট, রাশিয়ান রুট ও স্প্যানিশ রুট। পাচার হওয়া নাগরিকদের দিয়ে দাসবৃত্তি করানো হয় রেস্টুরেন্ট, যৌনপল্লি, পানশালা বা অন্যান্য প্রাপ্তবয়ষ্ক বিনোদনকেন্দ্রে।
ডেইলি মেইলের খবরে বলা হয়, এশিয়া ও ইউরোপ পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে মানবপাচারের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে, ২০০০ সালে ডোভার বন্দরে একটি ট্রাক থেকে ৫৮ জন চীনা নাগরিককে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজন বেঁচে ছিলেন। তারা চীনের ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে এসেছিলেন। টমেটোর কার্গোতে করে অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে আসার পথে ২০০৪ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের মোরেকাম্বে বে তে প্রাণ হারান আরও ২১ চীনা নাগরিক। এই ঘটনায় একজন ডাচ ট্রাক ড্রাইভারকে ১৪ বছরের জেল দেওয়া হয়েছিল।
শুধু চীন নয়, পণ্যবাহী এসব লরিতে করে বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ যুক্তরাজ্যে আসার চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালের আগস্টে ৩৬ আফগান শিখকে অ্যাসেক্সের টিলবুরি বন্দর থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে একজন মারা যান। লরিটি বেলজিয়াম হয়ে এসেছিল। এছাড়া, ২০০১ সালেও ডোভারে পাওয়া যায় ২৬ শ্রীলংকান শরণার্থীকে। ফ্রান্স থেকে প্রতিমাসে অন্তত দুইশ জন শরণার্থী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করেন বলে বিভিন্ন তথ্যে উঠে আসে।
চীন থেকে যুক্তরাজ্যে আসতে লরিগুলোর কয়েকমাস লেগে যায়। এভাবে অবৈধভাবে আসার পথে মৃত্যুর কারণ, পানি-স্বল্পতা, শ্বাস নিতে না পারা, অনাহার বা অতিরিক্ত শীত। মানবপাচারকারীরা এশিয়া হয়ে ইউরোপ যেমন বুলগেরিয়া তারপর হল্যান্ড বা বেলজিয়াম হয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেন বলে জানা যায়।
এবার অ্যাসেক্সে ৩৯ চীনা নাগরিকের মরদেহ উদ্ধার ২০০৫ সালে লন্ডন বোমা হামলার পর সবচেয়ে বড় হত্যার ঘটনা। এই ট্র্যাজেডি এমন সময়ে ঘটল যখন যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেসব ইউরোপীয় দেশ মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো ইইউর অভিন্ন বাজার ব্যবস্থায় যুক্ত থাকায় লরিগুলো সীমান্তে খুব বেশি যাচাই বাছাইয়ের সম্মুখীন হয় না। যদি না সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা নিরাপত্তাকর্মীরা এ বিষয়ে আশঙ্কা না জানান। আর বর্ডার পুলিশের এই শিথিল আচরণের সুযোগ নেয় মানবপাচার চক্রগুলো।
ইউরোপে সর্বশেষ এত বৃহৎ ট্র্যাজেডি ঘটেছিল ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট। অস্ট্রেয়িার মহাসড়কের ট্রাক থেকে ৭১টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের মধ্যে শিশুও ছিল।
ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির মানবপাচার বিষয়ক গবেষক গ্যাব্রিয়েলা সানচেজ এসব বিষয়ে আশঙ্কা জানিয়ে আল-জাজিরাকে বলেন, এভাবে ঘটা অনেক মৃত্যুই হয়ত অজানা রয়ে যায়।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতাকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, অথচ তারা ব্যস্ত অভিবাসীদের নিয়ে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে নয়।
বর্ডারে আরও বেশি চেকপয়েন্ট বসানো উচিত বলে মত দেন এই গবেষক।
যুক্তরাজ্যে বসবাসের জন্য আবেদন করতে হলে অবশ্যই আবেদনকারীকে দেশটিতে অবস্থানের নিয়ম রয়েছে। আর তাই নিরাপদে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় পাওয়া অনেকটা অসম্ভবের মতো। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলে এই ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা আরও ঘটবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চীন বিশেষ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন মানবপাচার মানবপাচার রুট যুক্তরাজ্য