Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্তঃধর্মীয় সংলাপ: উগ্রবাদী চিন্তা থেকে অন্য ধর্মের ওপর আক্রমণ


২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৮:২২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে এক আন্তঃধর্মীয় সংলাপে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বলেছেন, প্রত্যেক ধর্ম সম্প্রীতির কথা বলে, কিন্তু কিছু মানুষ ধর্মের মূলসুর কি সেটাই বোঝে না। ভুল চিন্তা থেকে তারা ভাবে, তার নিজের ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এই চিন্তা একটি উগ্রবাদী চিন্তা। এই উগ্রবাদী চিন্তা থেকেই তারা অন্য ধর্মের লোকের ওপর আক্রমণ করে। দেশে বিভিন্ন সময় দুর্বল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর যেসব আক্রমণ হয়, তা এই উগ্রবাদী চিন্তার ফল।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটায় আর্চবিশপ ভবন সভাকক্ষে এই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বিষয়ক বিশেষ আলোচনা সভা হয়েছে। খ্রিস্টিয় ঐক্যপ্রচেষ্টা এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ কমিশন, চট্টগ্রাম আর্চডায়োসিস এই সভার আয়োজন করে। সভায় খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা অংশ নেন। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন খ্রিস্টিয় ঐক্যপ্রচেষ্টা এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ কমিশন, চট্টগ্রাম আর্চডায়োসিসের কো-অর্ডিনেটর জেমস গোমেজ।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম আর্চডায়োসিসের জুডিশিয়াল ভিকার ফাদার লেনার্ড সি. রিবেরু বলেন, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্প্রীতি আছে সেটা বিশ্বে অনুসরণযোগ্য। কিন্তু এরপরও কিছু ঘটনা এখানে ঘটে। এটা মূলত ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব যার ফলে সম্প্রীতিতে ফাটল এবং অজ্ঞানতা থেকে হয়। খ্রিস্টান ধর্ম বলছে, কাউকে বাদ দিয়ে অর্থাৎ কোনো মানুষকে বাদ রেখে সম্প্রীতি হতে পারে না, সেটা যে ধর্মের বা যে জাতিগোষ্ঠীর হবে হোক। সম্প্রীতি তৈরি করতে হবে মানুষে-মানুষে, নির্দিষ্ট কোনো ধর্মে নয়।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল হোসেইন বলেন, ‘উগ্রবাদী চিন্তা থেকে এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোককে আক্রমণ করে। ভোলায় সাম্প্রতিক যে ঘটনা ঘটেছে, একই ঘটনা কিন্তু আগেও আমাদের দেশে ঘটেছে। এর সবই উগ্রবাদী চিন্তার ফল। ধর্ম যে শুধু চর্চার বিষয় নয়, এটি যে পড়াশোনা করে ধারণের বিষয় সেটা আমরা অনেকসময় মাথায় রাখি না। আবার আমি এক ধর্মের অনুসারী বলে যে আরেকটি ধর্ম সম্পর্কে আমার পড়াশোনার প্রয়োজন নেই, সেটিও সঠিক নয়। প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থ পড়তে হবে। প্রত্যেক ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। অন্য ধর্মে কি লেখা আছে সেটা যদি আমি জানি, তাহলে আমার মধ্যে ওই ধর্ম সম্পর্কে কোনো বিদ্বেষ থাকবে না। সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে এই বিশ্বকে শান্তিময় করে তুলতে হবে, এটাই হোক প্রত্যেক ধর্মের মূলসুর।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, ‘আমাদের সমাজে ক্ষমতা পেলে অন্যকে মানুষ বলে গণ্য না করার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অথচ ধর্ম বলছে, যত বেশি উপরে উঠবে তত বেশি বিনয়ী হবে। কিন্তু আমাদের সমাজে হচ্ছে উল্টোটা। ক্ষমতার জোরে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুকে মানুষ বলে মনে করে না। আমি যদি ভাবি যে, আমার মতবাদ বা আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, বাকি ধর্মগুলো কিছুই না, তখন অন্য ধর্মগুলো গৌণ হয়ে পড়ে। এতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। অথচ মানুষকে ভালো না বাসলে প্রভুকে ভালোবাসা যায় না। এটাই বৌদ্ধ ধর্মের মূলরীতি।’

অধ্যাপক স্বদেশ চক্রবর্তী বলেন, ‘ভোলায় সাম্প্রতিক যে ঘটনা ঘটেছে, গত কয়েক বছরে আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেটা দেখেছি। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষকে ভালোবাসা। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে মুচি, কে শিক্ষক এই ভেদাভেদের ঊর্দ্ধে যদি আমরা উঠতে না পারি তাহলে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হবে না। হিন্দু-মুসলিম, মুচি-শিক্ষক সবাই মানুষ। মানুষকে বাদ দিয়ে, মানুষকে দূরে সরিয়ে কোনো সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা হবে না সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, তখন শুধু সনাতন ধর্মের জন্য করে না। সমগ্র মানবজাতির জন্য করে। সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই- এর চেয়ে বড় সম্প্রীতির জয়গান আর হবে পারে না।’

সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম আর্চডায়োসিসের আর্চবিশপ মজেস এম কস্তা বলেন, ‘সংলাপ হচ্ছে একে অপরের কাছে আসার, একে অপরের অন্তরে ধারণের একটা পদ্ধতি। সংলাপের মাধ্যমে সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে ওঠে। এই সংলাপ অব্যাহত থাকবে। ১০ জন নিয়েও সংলাহপ করা যায়, ১০০-৫০০ জন নিয়েও করা যায়। মূলসুরটা থাকবে শুধু সম্প্রীতি। ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে, মানুষে-মানুষে সম্প্রীতিই হচ্ছে এর মূলসুর।’

জেমস গোমেজ বলেন, ‘সারাবিশ্বে আজ যে ধরনের সংঘাত, রক্তপাত, হানাহানি চলছে, মানুষে-মানুষে বিভেদ-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে, তার থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে সম্প্রীতি। সব ধর্মের মানুষকে সম্প্রীতির মন্ত্রে এক করাই হচ্ছে এর সমাধান। মানুষ হিসেবে নিজেকে বড় মনে না করে আমরা যদি বিনয়ী হই, নত হই তাহলে সংঘাত অনেকাংশে কমে যাবে। সংলাপের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিকতাবোধ জাগানোর একটা প্রয়াস আমরা শুরু করেছি মাত্র।’

‘সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় আমাদের নেতৃত্ব’ শীর্ষক এই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ সঞ্চালনা করেন সেন্ট স্কলাস্টিকা স্কুলের শিক্ষিকা মার্গারেট ইউগিনি। এতে বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গীতও পরিবেশন করা হয়। উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকেরাও।

আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ধর্মীয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর