Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাজার হাজার বেনামি অভিযোগে কাবু ‍দুদক


২৭ অক্টোবর ২০১৯ ২৩:০৯

ঢাকা: প্রতিবছর হাজার হাজার বেনামি অভিযোগ জমা পড়ছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শত্রুতা কিংবা কারও স্বার্থে আঘাত লাগলেই দুদকে দেওয়া হচ্ছে বেনামি অভিযোগ। এসব অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে শুধু দুদক নয়, সংস্থাটির অন্যান্য তদন্তভুক্ত দফতরের সময়, শ্রম, অর্থ, জনবল ও কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। এসব বেনামি অভিযোগে কখনো কখনো নিরপরাধ ব্যক্তিও ফেঁসে যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দুদক।

বিজ্ঞাপন

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ বছরে কমিশনে সরাসরি অভিযোগ এসেছে প্রায় ৬৩ হাজার। এসবের মধ্যে অনুসন্ধান হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৪০৮টির। বাকি ৫৯ হাজার ৬৩৯টি অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে ভিত্তিহীন ও দুদকের তফসিল বহির্ভূত বলে জানা গেছে। যা মোট অভিযোগের ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ মোট অভিযোগের মাত্র ৭ শতাংশ অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে ১৫ হাজার ৪৯৭টি। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ১৯৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মোট অভিযোগের মাত্র ৮ শতাংশ অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়। আমলে নেওয়া হয়নি বাকি ৯২ শতাংশই। ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ৬০৬টি অভিযোগের মধ্যে ১ হাজার ২৬৫টি অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়। শতকরা হারে যা ৮ শতাংশ। ২০১৭ সালের ১৭ হাজার ৯৫৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯৩৭টি অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়। যা মোট অভিযোগের মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ অভিযোগই আমলে নেওয়া হয়নি। ১২ হাজার ৯৯০টি অভিযাগ আসে ২০১৬ সালে। এরমধ্যে ১ হাজার ৭৬৬টি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ হয়। যা শতকরা হারে প্রায় ৭ শতাংশ। ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৪১৫টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ১ হাজার ২৪০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। ২০১৪ সালে সাড়ে ১২ হাজার অভিযোগ থেকে ১ হাজার ৬৮৯টি অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয়।

দুদক বলছে, যেকোনো অভিযোগ আমলে নিতে হলে কয়েকটি বিষয় থাকতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ অভিযোগেই সেই তথ্যগুলো থাকে না। যেমন, অভিযোগটি কমিশনের তফসিলভুক্ত অপরাধ কিনা, অভিযোগটি সুনির্দিষ্ট ও তথ্যভিত্তিক কিনা, অপরাধ সংঘটনের সময়কাল উল্লেখ করা হয়েছে কিনা, অভিযুক্ত ব্যক্তির অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্টতা, অভিযুক্ত ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের পূর্নাঙ্গ ঠিকানা উল্লেখ থাকে কিনা, অভিযোগের গুরুত্ব ও মাত্রা, অভিযোগের আর্থিক সংশ্লেষের পরিমাণ, অভিযোগকারীর নাম ও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা থাকা, অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইন পর্যালোচনা করে দেখা হয় যাতে অভিযোগটি আদালতে প্রমাণযোগ্য কিনা। কিন্তু অধিকাংশ অভিযোগে অভিযোগকারীর নাম থাকলেও সেটা ভুয়া এবং কোনো ঠিকানা উল্লেখ করা হয় না।

বিজ্ঞাপন

দুদক সূত্র আরও জানায়, সংস্থাটির নিজস্ব গোয়েন্দা ব্যবস্থা না থাকায় দুর্নীতি বিষয়ক তথ্যের জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের দেওয়া তথ্যের ওপর। এর মধ্যে কোনটির অনুসন্ধান হবে, কোনটির হবে না, সেটি নির্ধারণ করে একটি ‘বাছাই কমিটি’। কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অনুসন্ধানযোগ্য’ অভিযোগগুলো কমিশনারের (অনুসন্ধান) কাছে যায়। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু হয়। এছাড়া ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দফতর থেকে প্রতিবেদন আকারে পাওয়া তথ্য, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো প্রতিবেদন, দুদকের কর্মকর্তাদের সংগৃহীত অভিযোগ এবং আদালত থেকে প্রেরিত পিটিশন কিংবা সিআর মামলা দুদকের অনুসন্ধানের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে বেনাপোল কাস্টম হাউজের কমিশনার বেলাল হোসাইনের বিরুদ্ধে একটি বেনামি অভিযোগ দেওয়া হয়। কমিশন সেই অভিযোগ আমলেও নেয়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। তবে দুদকের যশোর বিভাগীয় কার্যালয় থেকে অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির সত্যতা পায়নি। এমনকি তার বিরুদ্ধে এর আগেও বেনামী অভিযোগ দেওয়া হয় এবং ৩ বার দুদক তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। একই সাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দীর্ঘ ৯ মাসের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগেরও সত্যতা পাইনি এনবিআর। এছাড়া বেনাপোল কাস্টম হাউজ থেকে কাস্টম ও ভ্যাট এসোসিয়েশনকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে এই বেনামি অভিযোগে কি পরিমাণ সময়, শ্রম, কর্মঘণ্টা এবং মেধার অপচয় হয়েছে সেটা তুলে ধরা হয়েছে।

সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, দুদকের পূর্ণাঙ্গ কমিশন (কমিশনার পযায়ে), দুদকের সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক, পরিচালক এবং তদন্তকারী উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রশাসন শাখা, সদস্য পর্যায়ে (অতিরিক্ত সচিব) একজন কর্মকর্তার ১৫ অভিযোগে প্রায় ৬ মাসের তদন্তের চাপ, শাখা সহকারী ও কম্পিউটার অপরেটর, বেনাপোল কাস্টম কমিশনারের মানসিক চাপ, দুদকের পত্র নিয়ে কর্মকর্তাদের দফায় দফায় বৈঠক ও পুরনো নথি পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্ট ৩ জন বিসিএস ক্যাডার অফিসারের সময় ও পরিশ্রম, যুগ্ম-কমিশনার ও সহকারি কমিশনারের একাধিকবার শুনানীতে যাওয়া, দীর্ঘ সময় নিয়ে নথি খুঁজতে ১০ জন কর্মকর্তার পরিশ্রম, প্রায় দেড় শতাধিক নথির ফটোকপি, জরুরি আমদানি রফতানিতে দেরি, সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী অংশীজনদের সময়ক্ষেপন, অভিযোগ সামলাতে গিয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউসে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ধস হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে কিছু কিছু অভিযোগে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক শত্রুতার অংশ হিসেবে ঢাকা বা ঢাকার বাইরের সুনির্দিষ্ট বাড়ি ও ফ্ল্যাটের ঠিকানা উল্লেখ করে বেনামী অভিযোগ দেওয়া হয়। এ সমস্ত ঠিকানা সরেজমিনে ১-২ঘণ্টার মধ্যে যাচাই করা সম্ভব। যেটার জন্য দুদক ২-৩ মাস সময় নিয়ে চিঠি ইস্যু করে। এতে করে যাচাইও ঠিক মতো হয় না আবার আমলে নেওয়ার যোগ্য নয় এমন অভিযোগও আমলে নিয়ে তদন্ত করা হয়।

এ বিষয়ে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, দুদক তুলনামূলক কম অভিযোগ আমলে নেওয়ার পেছনে কিছু কারণ থাকতে পারে। অভিযোগগুলো সিংহভাগ হচ্ছে বেনামি। আইনি কাঠামো অনুসারে বেনামি অভিযোগ আমলে নেওয়ার কথা নয়। তবে আমাদের কাছে অভিযোগ আসে, অনেক অভিযোগ দুদকের এখতিয়ার বহির্ভূত এটাও একটা বাস্তব কারণ হতে পারে। তবে কোন বিবেচনায় অভিযোগগুলো আমলে নেওয়া হলো সেটি পরিষ্কারভাবে মানুষকে জানানো। অপরদিকে কোন কোন বিবেচনায় অভিযোগ আমলে নেওয়া হলো বা সিংহভাগ আমলে নেওয়া হলো না সেটি সবাইকে জানানো না হলে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। আর পরিষ্কারভাবে এই তথ্যগুলো দুদকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা দরকার।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দুদক আইনের তফসিলভুক্ত দুর্নীতি আমরা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেই। যেগুলো তফসিলভুক্ত নয় সেগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরে পাঠানো হয়। এছাড়া সব অভিযোগ আমরা আমলে নিতে পারি না। তাই দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধের বিষয়ে কমিশনে অভিযোগ দিতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানান।

কাবু দুদক বেনামি অভিযোগ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর