সংকুচিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার
২৯ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:৩০
ঢাকা: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে যে কয়েকটি খাতের বিশেষ অবদান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম অভিবাসন খাত। বলা যায়, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তৈরি পোশাক শিল্পের পরেই জনশক্তি রফতানি খাতের অবস্থান। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গেল অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ ১১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ১৮৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এছাড়া জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের অবদান সাড়ে ৯ শতাংশ। তবে স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ অবদান রাখা এই খাত এখন ঝুঁকির মুখে।
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদায়ও পরিবর্তন আসছে। কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা এবং অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের পাশাপাশি বেসরকারি জনশক্তি রতানিকারকদের সিন্ডিকেট আর দালালদের দৌরাত্ম্যে সংকুচিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসন খাত। তার ওপর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানিতে সংকট, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে নতুন করে।এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের শ্রম রফতানির ৮০ ভাগই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। নানা অসঙ্গতির কারণে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কয়েকটি শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের জন্য বিধিনিষেধ তৈরি হয়েছে। নানা কারণে টানা সাত বছর কর্মী নিয়োগ বন্ধ রাখার পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জন্য বাজার খুলে দেয় সৌদি আরব। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় চাকরির বাজার সৌদি আরবে সাড়ে ১২ লাখ বাংলাদেশি কাজের সুযোগ পায়। তবে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ বেকারত্ব কমাতে ১২ ধরনের কাজে কোন বিদেশী কর্মী নেবে না সৌদি সরকার। ফলে এসব কাজে যুক্ত পুরনো প্রবাসীরাও দেশে ফিরে আসছেন।
সৌদি আরবের পর বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম চাকরির বাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ১৬ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আরব আমিরাতে চাকরি নিয়ে গেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হওয়ায় আমিরাত সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়; যা সরকার নানা দেনদরবার করেও চালু করতে পারেনি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আরব আমিরাতের বাজার খুলে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
কর্মী পাঠাতে বিধিনিষেধ রয়েছে তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায়ও। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে নিয়োগকারী ১০টি সংস্থার এক সিন্ডিকেট শ্রমিক নিয়োগ ব্যবসাকে একচেটিয়াকরণ এবং ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের জের ধরে বন্ধ রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও। ২০১৮ সালে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন কর্মী নিলেও এখন আর নতুন করে ভিসা দিচ্ছে না দেশটি। তবে মালেশিয়ায় নতুন সরকার গঠন হলে বিদেশ থেকে কর্মী নিতে নতুন করে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়টি এখনও ঝুলে রয়েছে।
মালয়েশিয়া শ্রমবাজার খুলতে সরকারের পক্ষ থেকেও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েক দফা আলোচনার পরও বাংলাদেশি কর্মীদের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় ৫ নভেম্বর ফের আলোচনায় বসতে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ।
এদিকে কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে লেবানন, জর্ডান, ওমান, কাতার এবং সিঙ্গাপুরও। বিএমইটি’র তথ্যানুযায়ী লেবানন ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৬ হাজার বাংলাদেশি নিয়োগ দিয়েছে। বর্তমান তা ৭ হাজারে নেমেছে। বাহরাইন বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ প্রায় বন্ধ করেই দিয়েছে। ২০১৮ সালে ৮১১ জন কর্মী নিলেও চলতি বছরের আট মাসে মাত্র ১৩২ জন শ্রমিক সেখানে যেতে পেরেছে। অথচ এক সময় বছরে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারেরও বেশি।
বিএমইটি’র তথ্য বলছে, গেল দুই বছরে জনশক্তি রফতানি সংকট আরও তীব্র হয়েছে। চলতি বছরের আট মাসে বিভিন্ন দেশে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৮৪ কর্মী নিয়োগের চাহিদা ছিল। ২০১৮ সালে বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন কর্মী কাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে যান। তার আগের বছর ২০১৭ সালে এর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন। সে হিসাবে প্রতিবছরই বড় আকারে কমছে জনশক্তি রফতানি।
এ পরিস্থিতিতে অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বিদেশে শ্রমবাজার সংকুচিত হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে ও চাকরির বাজারে। এ প্রসঙ্গে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় ও অভিবাসী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব এর জন্য দায়ী। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব অসততা রয়েছে তা দূর করতে পারলে এবং অভিবাসীদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ঝুঁকিতে পড়ত না। বরং চাকরির বাজার থেকে রেমিট্যান্স আরও বেশি আসত।
অভিবাসন খাতের এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকরাও। বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারক আলী হায়দার চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা, শ্রমিকদের এখনও দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো যায় না। পাশাপাশি অবৈধ পথে শ্রমিক পাঠানোও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে অবৈধ পথে যাওয়া শ্রমিকরা নানাভাবে আইন লঙ্ঘন করে সেখানে জটিলতা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে রয়েছে সিন্ডিকেট সমস্যা। এসব দূর করতে না পারলে পুরনো শ্রমবাজারে বিশ্বস্ততা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।’
এদিকে অভিবাসন খাত নিয়ে এত সংকটের মধ্যেও নতুন শ্রমবাজার শুরুর সম্ভাবনা দেখাচ্ছে জাপান। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জাপানে প্রথম শ্রেণির পেশা চিকিৎসক ও প্রকৌশলী থেকে শুরু করে অবকাঠামো এবং ছোটখাটো অনেক খাতে কর্মী নেওয়ার চাহিদা রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা জানান, এরই মধ্যে দেশটিতে কর্মী পাঠাতে একটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। দক্ষ কর্মীই সেখানে পাঠানো হবে। বিএমইটি সূত্র জানিয়েছে, গেল বছর জাপানে গেছে ১৬৩ জন। এ বছর প্রথম তিন মাসে ৪০ জন। এছাড়া প্রায় ত্রিশটি প্রশিক্ষক কেন্দ্রে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকেও জাপানে পাঠানো হবে।
বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার চাহিদা রয়েছে থাইল্যান্ডেও। নার্স, গৃহশ্রমিক ও নির্মাণ কাজে কয়েক লাাখ কর্মী নিয়োগের চাহিদা রয়েছে দেশটিতে। সেক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও বিমানভাড়া দেওয়ার কথাও বলেছেন।
এদিকে নতুন করে কর্মী পাঠাতে অভিবাসন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি বিমান ভাড়ার লাগাম টেনে ধরার তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) কর্মকর্তারাও। এ প্রসঙ্গে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রির্সাচ ইউনি (রামরু) চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। তা না হলে বিগত দিনের মত মুখ থুবরে পড়বে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি।’
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ১৫৮টির বেশি দেশে জনশক্তি রফতানি করে বাংলাদেশ। বিএমইটি’র তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে বিদেশে।