জান্নাতি হত্যা মামলা, এখনো পলাতক পাউবি প্রকৌশলী সেই গৃহকর্তা
৩০ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:১২
ঢাকা: বগুড়ার গাবতলীর সুকানপুকুরের ভ্যানচালক জানু মোল্লার চার সন্তানের মধ্যে বড় মোসাম্মাৎ জান্নাতি আখতার (১২)। তেলিহাটা ফকিরপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র জানু মোল্লার পরিবারের তিনবেলা খাবার জোটে না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বছর চারেক আগে, ৮ বছরের মেয়েকে তুলে দেন রোকসানা ও সাইদ আহমেদ দম্পতি কাছে। শর্ত ছিল- শুধু তাদের ছোট শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করবে জান্নাতি। তাকে বাসার অন্য কোনো কাজ করতে হবে না। বিনিময়ে বেতন নয় শুধু থাকা খাওয়া আর পরে বিয়ের খরচ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ওই দম্পতি।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) সারাবাংলাকে এসব তথ্য জানান জান্নাতির মামা আরিফুল ইসলাম। বলেন, জান্নাতির মা শামসুন নাহার মেয়ে শোকে পাগল প্রায়। তাকে ঘরে রাখতে পারছি না আমরা। খুব কান্নাকাটি করছেন। বারবার মেয়ের কবরের পাশে ছুটে যাচ্ছেন।
জান্নাতির বাবা জানু মোল্লা টেলিফোনে সারাবাংলাকে বলেন, ২৩ অক্টোবর ভোরে ঢাকা থেকে রোকসানা পারভীন আমাকে টেলিফোন করেন। বলেন, জান্নাতি অসুস্থ, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তখন আমি ঢাকায় যেতে রওনা দিই। কিন্তু সিরাজগঞ্জে পর্যন্ত পৌঁছানোর পর জানতে পারি জান্নাতি মারা গেছে। তখন আবার আমি বাড়ি ফিরে কয়েকজন আত্মীয় স্বজনসহ আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ওইদিন রাত ৩টায় ঢাকা পৌঁছায়। পরে হাসপাতালে জান্নাতির লাশ পাই।
আরও পড়ুন:গৃহকর্মী জান্নাতিকে ধর্ষণের পর হত্যা, ২ দিন পর থানায় মামলা
জানু মোল্লা আরও বলেন, চাকরি বদলি হলে ওরা জান্নাতিকে ঢাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু আমরা সেসময় আপত্তি করি। তারপরও তারা অনেকটা জোর করেই নিয়ে আসে। তারা আমাদের বলে তাদের বাচ্চার সঙ্গে খেলা ছাড়া জান্নাতিকে আর কিছুই করতে হবে না।
কিন্তু আমরা ফোন করে জান্নাতিকে চাইলে রোকসানা বলত, সে বাইরে আছে, বাসায় ফিরে ফোন দেবেন। যদিও আর ফোন দিতো না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জান্নাতি একটু বড় হয়েছেতাকে আর ঢাকায় রাখব না। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা জান্নাতিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম। কিন্তু তার আগেই আমরা মেয়েকে হারালাম।
আরও পড়ুন: মর্গে গৃহকর্মীর মরদেহ, তথ্য দিতে গড়িমসি পুলিশের
জানু মোল্লা বলেন,আমি নিজে মোহাম্মদপুর স্যার সৈয়দ রোডে জান্নাতি যে বাসায় থাকত সেখানে যাই। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি জান্নাতিকে প্রায় দিনই যেকোনো অজুহাতে মারধর করা হতো।
জান্নাতি হত্যা মামলার প্রধান আসামি গৃহকর্ত্রী রোকসানা পারভিন সারাবংলাকে জানিয়েছিলেন,জান্নাতীর মৃগী রোগ আছে। বিষয়টি পরিবার থেকে অস্বীকার করা হয়। জান্নাতীর বাবা বলেন, তার মেয়ের কোনো ধরণের রোগ ছিল না
পরে জান্নাতীর বাবা জানু মোল্লা গত ২৪ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সেলিম রেজা বলেন, মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাত করার চিহ্ন রয়েছে। দুই হাত, গলা, মুখমণ্ডল, দুই উড়ুতে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ধর্ষণের আলামতও পেয়েছি। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে শিশুটির মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। তবে সবকিছু স্পষ্ট হবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর।
এদিকে, জান্নাতী হত্যা মামলার প্রধান আসামী গৃহকর্ত্রী রোকসানা পারভিনকে গ্রেফতার করলেও গৃহকর্তা সাইদ আহমেদ এখনও পলাতক। পিরোজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবি) নির্বাহী প্রকৌশলী এই সাইদ আহমেদ জান্নাতি হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি। ।
এ বিষয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আবদুল আলিম সারাবাংলাকে বলেন, জান্নাতীকে হত্যার কথা স্বীকার করে এরই মধ্যে গৃহকর্ত্রী রোকসানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর তাকে আদালত কারাগারে পাঠিয়েছে। ঘটনার দিন থেকেই গৃহকর্তা সাইদ আহমেদ পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। তার বাসাতে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
মো. আবদুল আলিম আরও বলেন, পিরোজপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডে আমরা এখনো অভিযান চালাইনি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। সেখানে আসলে ধর্ষণের আলামত মেলে কিনা সেটা দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর যেহেতু গৃহকর্ত্রী দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন তাই গৃহকর্তাকে এমনিতেই হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। এরপরেও গৃহকর্তা যেহেতু মামলার দ্বিতীয় আসামী তাই যেখানেই পাওয়া যাবে তাকে গ্রেফতার করা হবে।
গত ২২ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে গৃহকর্ত্রী রোকসানা পারভিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে জান্নাতিকে নিয়ে আসেন। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করলে জান্নাতির মরদেহ রেখে চলে যান তিনি। পরেরদিন মরদেহ মর্গে নেওয়া হয়। এদিন রোকসানাকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রোকসানা ধর্ষণের বিষয়টি গোপন করেন। তিনি সেদিন বলেন, জান্নাতি আগের দিন বিকেলের দিকে ঘুমিয়েছিল। রাত ১০টার দিকে তার কোনো সাড়াশব্দ না পেলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।