নাগাল্যান্ড ও মণিপুর: দুই অশান্ত প্রতিবেশী
৩১ অক্টোবর ২০১৯ ১৭:৩৫
ভারতের উত্তর-পূর্বে সেভেন সিস্টার স্টেটস-এর দুই অশান্ত প্রতিবেশী রাজ্য নাগাল্যান্ড ও মণিপুর। সুযোগ পেলেই স্বাধীনতার দাবিতে ফুঁসে ওঠে এ দু রাজ্যের অস্ত্রধারী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এছাড়া নাগা ও মণিপুরীদেরও রয়েছে জাতিগত বিরোধ। তাই অঞ্চলটিতে বসবাসরত অধিবাসীদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় কেন্দ্রীয় প্রশাসনের রয়েছে ভিন্ন নরজদারি; জমি হস্তান্তরসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ।
এ বছর জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে উদ্বেগ বাড়ে। ৩৭০ ধারা রদকে দেখা হয় রাজ্যগুলোর জন্য ‘রেড অ্যালার্ট’ হিসেবে। এসবের মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতা দিবসে প্রভাবশালী নাগা স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) নাগাল্যান্ডের বেশ কিছু অঞ্চলে নিজস্ব পতাকা উড়িয়ে ‘নিজস্ব স্বাধীনতা’ উদযাপন করে।
২৯ অক্টোবর অকস্মাৎ মণিপুরের রাজনৈতিক নেতা ইয়াম্বেম বিরেন এবং নারেংবাম সমরজিত লন্ডন থেকে ‘দ্য মনিপুর স্টেট কাউন্সিল’ গঠনের কথা জানান। তবে মণিপুরের প্রাক্তন রাজা লেইশিম্বা সানাজাওবার ভিডিওবার্তায় নিশ্চিত করেন এই ঘোষণার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ইতোমধ্যে এই দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধ উসকে দেওয়ার জন্য।
‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতাদের কাছ থেকে মণিপুরের এই স্বাধীনতা ঘোষণা এমন সময় এল যখন শান্তি আলোচনার অংশ হিসেবে নাগাল্যান্ডের গভর্নর আর এন রবি ও নাগা প্রতিনিধিরা অক্টোবর মাসজুড়ে বৈঠক করেছেন। এদিকে পুরো ঘটনা নিয়ে উৎকণ্ঠা জানিয়ে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে আলোচনা করেছেন মণিপুরের সর্বদলীয় প্রতিনিধিরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করেন নাগাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে এমন কোনো বিষয় থাকবে না যাতে মণিপুরীরা ও তাদের ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মণিপুরে পাহাড়ি এলাকায় থাকে কুকি সম্প্রদায়ের লোকেরা। এই আদিবাসীদের বসবাস, ভারত, বাংলাদেশ মিয়ানমারে। ১৩ সেপ্টেম্বর দিনটি তারা পালন করে কালো দিবস হিসেবে। কারণ ১৯৯৩ সালে নাগা অস্ত্রধারীরা মণিপুরে জোউপি গ্রামে ১১৫ জন কুকিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। যেটি জোউপি হত্যাযজ্ঞ নামে পরিচিত।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাগা সম্প্রদায় যখন ‘বৃহৎ নাগাল্যান্ডের’ স্বপ্নে বিভোর। তখন কুকিরা বিস্তীর্ণ কৃষি জমিকে নিজেদের পবিত্র ভূমি হিসেবে মনে করে। মূলত ভূমি নিয়ে বিরোধের জেরে লেগে আছে এই দ্বন্দ্ব। মণিপুরীদের অভিযোগ ৯০’ এর দশকে অন্তত ১১৫৭ জনকে হত্যা করেছে নাগারা।
মণিপুরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হামলার পেছনে দায়ী করা হয় ন্যাশনাল সোসিয়ালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডকে (এনএসসিএন)। কুকিরা জানায়, ১৯৯২-১৯৯৭ সালের মধ্যে নাগাদের এই সংগঠনটি তাদের ৩৫০টি গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করেছে।
নির্বিচারে হত্যা ও এসব উচ্ছেদের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেখানে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী মেইতেই। তারা ভারত সরকারের কাছ থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার ও ৩০ লাখ জনসংখ্যার মণিপুরে ছোট ছোট এমন বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায় রয়েছে আরও।
অপরদিকে নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলো হলো, নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল, নাগা ন্যাশনাল আর্মি ও ন্যাশনাল সোসিয়ালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডসহ অন্যান্যরা।
বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, নাগাল্যান্ডে প্রতিবছরই সেনা, বেসামরিক ও বিদ্রোহীদের প্রাণহানি হচ্ছে। ১৯৯২ সালে ৯৬, ১৯৯৩ তে ১৭৩, ১৯৯৪ তে ১৯২, ১৯৯৫ তে ২১৩, ১৯৯৬ তে ৩০৪, ১৯৯৭ তে ৩৬০, ১৯৯৮ তে ১১২, ১৯৯৯ তে ১৪৮, ২০০০ তে ১০১ জনের মৃত্যু হয়। পরবর্তী ১৯ বছরেও প্রাণহানি হয়েছে আরও শতশত মানুষের।
১৬ হাজার বর্গকিলোমিটার ও ২২ লাখ জনসংখ্যার অধিবাসী নাগারা স্বাধীনতা কিংবা স্বায়ত্তশাসনের দাবির ক্ষেত্রে মণিপুরীদের চেয়ে বেশি সোচ্চার ও আক্রমণাত্মক। বাধ্য হয়ে ভারত সরকার শান্তি আলোচনায় বসেছে ন্যাশনাল সোসিয়ালিস্ট কাউন্সিল বা এনএসসিএনর সঙ্গে। তবে ভারত সরকার নাগাদের নিজস্ব পতাকা ও সংবিধানের মতো স্পর্শকাতর দাবি মেনে নেবে না বলেই ধারণা করা যায়।
এদিকে মণিপুরীদের অভিযোগ, কেন্দ্র সরকার নাগাদের সঙ্গে এত আলোচনায় বসতে পারলে আমাদের সঙ্গে ‘হিসেব-নিকেশে’ বিরোধ কিসের? পূর্বের হত্যাকাণ্ডের বিচার না করলে প্রতিবেশী নাগাদের সঙ্গে বিরোধ মিটবে না বলেও জানায় তারা।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, স্ক্রল, দ্য হিন্দু
নাগাল্যান্ড বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বিশেষ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ভারত মণিপুর