Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুলিস্তানে মাদ্রাসার অন্দরমহলে যা ঘটত


২৫ নভেম্বর ২০১৭ ১০:২০

সারাবাংলা প্রতিবেদক

আব্দুর রহমান জিদান (১২)। হাফেজ বানানোর স্বপ্ন নিয়ে গুলিস্তানের মদিনাতুল উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করান বাবা হাফেজ উদ্দিন। গত চার বছর ধরে ওই মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ত। আর কিছু দিন গেলেই জিদান হাফেজ হয়ে বের হয়ে আসত। কিন্তু সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই মরে গেল। গত ১৯ নভেম্বর রাত দেড়টায় জিদানকে একই মাদ্রাসার ছাত্র আবু বকর (১৬) অনৈতিক সম্পর্কের জের ধরে গলা কেটে হত্যা করে। এরপর লাশ গুম করতে কোলে করে নিয়ে সেফটিক ট্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখে। হত্যার রাতেই আবু বকর পালিয়ে গেলেও র‌্যাব-৩ এর একটি দল গতকাল বুধবার রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে গ্রেফতার করে।

পরে বিকেল ৪টায় কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর সিও লেফটেনেন্ট কর্নেল মরানুল হাসান হত্যার বিষয়ে বলেন, গ্রেফতার হওয়া আবু বকর নিজেই জিদানকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে।

দায় স্বীকার করে আবু বকর বলেছে, ‘চার বছর ধরে একই মাদ্রাসায় দুজনই পড়াশুনা করত। আবু বকর সিনিয়র আর জিদান জুনিয়র। তাই আবু বকর নিজের সব ধরনের কাজ জিদানকে দিয়ে করাত। দীর্ঘদিন একই কাজ করায় জিদান একটা সময় বিরক্ত হয়ে যায়। কিছুদিন থেকে আবু বকর অনৈতিক কাজ করতে প্রস্তাব দেয় জিদানকে। এতে জিদান রাজি হয়নি। এর মধ্যেই আবু বকর জানতে পারে জিদান একই মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুর রহমানের সঙ্গে মেলামেশা করছে। জিদানকে ফলো করে দেখতে পায় জিদান একদিন রাতে আব্দুর রহমানের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করছে। এরপর গত ১৭ নভেম্বর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আবু বকর জিদানকে কিল ঘুষি ও থাপ্পর মারে। এ ঘটনা জিদান মাদ্রাসার হুজুর ইয়াসীনকে জানায়। ওই দিন ইয়াসীন হুজুর আবু বকরকে ডেকে মৌখিকভাবে শাসন করেন। এরপরই মুলত আবু বকর ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে এবং জিদানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।

সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় আবু বকর নিজের ফল কাটার ছুরি ধার দেয়। রাত ৯টার মধ্যেই খাওয়া শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর সবাই গভীর ঘুমে আছন্ন হলে রাত দেড়টার দিকে আবু বকর তার ট্রাঙ্ক থেকে ছুরি বের করে এক হাত দিয়ে জিদানের গলা চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে ছুরি গলায় চালিয়ে দেয়। একে একে তিনবার গলায় ছুরি চালানোর ফলে জিদানের গলা গভীরভাবে কেটে যায়। জিদানের গোঙ্গানির শব্দে দু একজন টের পেলেও রাত গভীর ও মশারি থাকার কারণে আসলে কী ঘটছে তা মাদ্রাসার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা দেড়শ ছাত্রের কেউই টের পায়নি। পরদিন সকাল বেলা আবু বকরের পালিয়ে যাওয়া এবং জিদান নিখোঁজ থাকায় শিক্ষক ও ছাত্ররা বিপাকে পড়ে। পল্টন থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে রক্তের দাগ দেখে দেখে সেফটিক ট্যাঙ্ক পর্যন্ত যায়। এরপরই জিদানের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৩ এর সিও বলেন, যেহেতু অনৈতিক সম্পর্কের জেরেই এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে ধারণা করা হচ্ছে ওই মাদ্রাসায় এরকম ঘটনা আরো ঘটেছে। এসব বিষয় তদন্ত করে বিস্তারিত বের করা হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, আপাতত আবু বকর নিজের দোষের কথাই বলেছে। তবে এর সঙ্গে কোনো শিক্ষক জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।

মাদ্রাসাটি পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ফুটবল খেলার মাঠের মতো বিশাল জায়গা নিয়ে টাইলস করা বড় একটি ঘর। মাঝখানে শিক্ষকদের থাকার জায়গা। দুই পাশের মেঝেতে ছাত্ররা ঘুমায়। আর চৌকির ওপর থাকেন শিক্ষকরা। ছাত্রদের মশারি নেই, শিক্ষকদের আছে। শিক্ষকদের হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন। ছাত্রদের মোবাইল নিষিদ্ধ। শিক্ষকদের জন্য আছে কম্পিউটার। ছাত্রদের সেখানে প্রবেশে মানা। বিশাল কক্ষের একদিকে রান্নাঘর। সঙ্গে অজুখানা। পাশেই রয়েছে বাথরুম ও টয়লেট।

মাদ্রাসায় গিয়ে সরেজমিনে কয়েক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেক সিনিয়র ছাত্র ও শিক্ষকদের কাজ করতেই জুনিয়রদের সময় চলে যায়। কাপড় কাঁচা, শুকানো, লন্ড্রি করা, খাবার নিয়ে আসা, খাবারের পর থালা-বাসন পরিস্কার করা, মোবাইলে টাকা ভরিয়ে দেয়া, গোসলের পানি তুলে দেওয়াসহ নানান প্রকার কাজ করতে হয়।

প্রসঙ্গত গত ১৯ নভেম্বর গুলিস্তান (ফ্লাইওভারের উত্তরে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের পেছনে) মদিনাতুল হাফিজিয়া মাদ্রাসার সেফটিক ট্যাঙ্ক থেকে একই মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র আব্দুর রহমান জিদানের  গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জিদানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার জালেশ্বর গ্রামে।আর আবু বকরের (যে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে) বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের কালিকাপুর এলাকায়। আবু বকর এর আগে দুই বছর সিদ্দিক বাজার মাদ্রাসায় হাফেজী পড়েছে। গত বছর একটি মসজিদে তারাবিও পড়িয়েছে। এবার তার মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার কথা ছিল।

এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোব রাতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ এলাকায় জেলা পরিষদ মার্কেট জামিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতনে অনীহা প্রকাশ করায় ওই মাদ্রাসার ছাত্র রায়হানকে (১৪) গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে আবিদুর রহমান নামে এক শিক্ষক। এর আগে ওই শিক্ষক একাধিকবার রায়হানকে যৌন নির্যাতনে বাধ্য করেছিল। যা রায়হান একই মাদ্রাসায় পড়া তার বড় ভাই রেজওয়ানকে বলেছিল। রান্না ঘরে থাকা বটি দিয়ে রায়হানকে জবাই করা হয়। পরবর্তীতে হুজুর আবিদুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। এ ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসাটি বন্ধ করে দেয়।

 

 


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর